হিমালয় ভ্রমণে যেতে চান যে বিষয়গুলো জেনে রাখবেন

শক্তিশালী কিংবা ক্ষমতাবান বলি, এই পৃথিবীতে হিমালয়ের চাইতে বড় পর্বতমালা আর নেই। ভারতীয় উপমহাদেশের সমভূমিতে অবস্থিত তিব্বতিয়ান মালভূমিতে তুষারের চাদর মাথায় দিয়ে এক অনন্যসাধারণ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে এই হিমালয় আর অনবরত হাতছানি দিয়ে ডেকে যাচ্ছে পর্বত জয়ের উন্মাদনায় মত্ত ভ্রমণপিয়াসীদের।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ দশ পর্বতের নয়টিই ধারণ করে আছে এই হিমালয় যার মধ্যে মাথা উঁচু করে আছে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটির আকর্ষণেই পরিপক্ব পর্বতারোহীদের কাছে নেপাল এক ভূ-স্বর্গের মতো। তবে তার মানে এই না, আপনি যদি একজন শিক্ষানবিশ পর্বতারোহী হোন মাউন্টেইন জয় করা আপনার জন্য অসম্ভব কিছু।

হিমালয়ের কাছে গিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ভূখণ্ডের স্বাদ পাওয়ার জন্য আপনাকে যে আগে থেকেই এক্সপেরিয়েন্সড হতে হবে এমনটাও নয়। আপনি যদি সম্পূর্ণ নতুন শিক্ষানবিশও হয়ে থাকেন আপনি ভ্রমণ করতে পারেন নেপালের আর সব প্রবেশযোগ্য জায়গাগুলো, জনপ্রিয় লাংটাং ন্যাশনাল পার্ক আর অর্জন করতে পারেন এমন কিছু দৃশ্যচিত্র যা আগে দেখেননি পৃথিবীর আর কোথাও।

দারুণ যে জায়গাগুলো অনুসন্ধানের মাধ্যমে আপনি শুরু করতে পারেন আপনার নেপালিজ হিমালয় ভ্রমণ :
একেবারেই প্রথম হিমালয়ান এডভ্যাঞ্চারার যারা তাদের জন্য প্রথম বন্দর হচ্ছে পোখারা যেটি নেপালের মূল ভূখন্ডে অবস্থিত বহু পর্যটকসমৃদ্ধ একটি শহর।

অগুণতি হোটেল, বার, রেস্টুরেন্ট আর ট্রেকিং শপ দিয়ে ভর্তি এই জায়গাটি আপনার প্রথম এডভ্যাঞ্চারকে সাফল্যমণ্ডিত করে দিতে সদা প্রস্তুত। এই পোখারাতে আপনি কয়েকদিন থাকবেন, মাউন্টেইনে যাত্রা করবেন কিন্তু এক গ্লাস মালাই চা এবং পোখারার বিখ্যাত এক টুকরো আপেল পাই খাবেন না তা হতেই পারে না।

অন্নপূর্ণা রেঞ্জে ঢোকার জন্য পোখারা হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রবেশপথ যেটি কিনা খুব নাটকীয়ভাবে এগিয়েছে প্রায় ২৫ কি.মি. উত্তরে, যেখানে আছে মাছের লেজ আকৃতির মাচাপুচারের চূড়া। আপনি চাইলেই শহর থেকে আসার পথে ট্রেকিং এজেন্সির সাথেই আসতে পারবেন তাই সাজসরঞ্জাম বহন করা, গাইড, দ্বাররক্ষী এইসব বিষয়ে ভোগান্তি পোহাতে হবে না।

আর আপনি যে লোকদের সাথে নিয়ে আসবে তারা আসলেই সেই এজেন্সীর কিনা তা নিশ্চিত হয়েই আসবেন। নতুন ট্রেকাররা সাধারণত সংগঠিত একটা ট্যুরকেই পছন্দ করে থাকেন যেখানে খুব সহজেই তার যাবতীয় সব ব্যবস্থা তৈরি থাকবে। পোখারা থেকে ট্যাক্সি বা বাস নানাভাবে অন্নপূর্ণা ট্রেইলের শুরু পর্যন্ত পৌঁছানো যায়।

পোখারা থেকে নানাভাবে হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। আপনি চাইলে হাইকিং করে এখান থেকে দীর্ঘ একটা ভ্রমণের মাধ্যমে দেখে আসতে পারেন শান্তিময় বৌদ্ধ স্তুপ যেখানে ঝিকঝিক করে আলো ছড়াচ্ছে বৌদ্ধের সাদা স্মৃতিস্তম্ভ আর এখানে দাঁড়িয়ে আপনি ফিওয়া টাল এবং পর্বতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। অসাধারণ মুহূর্তকে বন্দী করে রাখতে পারেন শারাঙ্কট ভিউ পয়েন্ট থেকে প্যারাগ্লাইডিং করে।

লাংটাং ন্যাশনাল পার্কে ট্রেকিং:
কাঠমুন্ডুর দক্ষিণে তিব্বতের সীমানা ঘেঁষে এই লাংটাং অঞ্চলটি অবস্থিত যেটি সর্বপ্রথম নেপালিজ হিমালয়ে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৬ সালে। অন্নপূর্ণা আর এভারেস্ট অঞ্চলের চেয়ে খানিকটা কম ভীড় হওয়ায় এই জায়গাটিকে এখন ট্রেকিংয়ের জন্য নেপালের সর্বোত্তম জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই জায়গাটিতে ভ্রমণ করে বিস্তৃত সবুজ তৃণভূমি আর উপত্যকার উপর বিছিয়ে থাকা প্রাচীন বনভূমির সন্ধান পাবেন আপনি। বসন্তকালে এই তৃণভূমিতে হরেক রকমের ফুলের যে চাদর তৈরি হয় তার জন্যেও নেপালের খ্যাতির কমতি নেই। শরৎকাল এলেই তারা যখন নিজেদের রঙ পরিবর্তন করে ফেলে লাংটাং ন্যাশনাল পার্ক তখন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জায়গা হিসেবে রূপধারণ করে।

পশুদের মধ্যে এখানে আছে তাহর ছাগল, হিমালয়ান কালো ভাল্লুক এবং লাল পান্ডা। হিমালয়ান লোকমুখে যে নামটি ঘুরে বেড়ায় সেই অলীক ইয়েতির সন্ধানের জন্যও এখানে কান পাতেন বিকাশমান ক্রিপ্টোজুওলজিস্টরা, পর্বতের আশেপাশে যেটি ঘুরে বেড়ায় বলে স্থানীয় মানুষদের ধারণা।

এভারেস্টের অঞ্চলে বিচরণ:
নেপালে ঘুরতে যাওয়া অধিকাংশ ভ্রমণকারীদের জন্যই পর্বতকূলের সম্রাট এই এভারেস্টের টোপটা এড়িয়ে যাওয়া দুর্দমনীয়। ৮,৮৪৮ মিটার উচ্চতার সর্বোচ্চ এই পর্বতের চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন তারাই জানেন কী নেশা জাগানিয়া তার হাতছানি!

এভারেস্ট বেস ক্যাম্প কোনো পিকনিক নয়, এটি প্রায় দুই সপ্তাহ সময় নেয়। উঁচু থেকে উঁচুতে যাওয়ার জন্য চারপাশের ঠাণ্ডার তীব্রতায় জড়িয়ে আসা প্রতিটা পদক্ষেপ জানে এর কাছে অন্নপূর্ণা সার্কিট কিছুই না!

এভারেস্ট এবং অন্নপূর্ণা অঞ্চলের দু’পাশের রাস্তা ধরে আপনি অনেকগুলো লজ পাবেন যেগুলো টি-হাউজ নামে পরিচিত, সেখানে আপনি বিশ্রাম কিংবা রাত কাটাতে পারবেন আরামদায়ক কোনো কক্ষে। পরিচিত হতে পারবেন স্থানীয়দের সাথে।

হিমালয় দেখতে হলে যা যা আপনাকে সাথে নিতে হবে:
যদি আপনি প্রথমবারের মতো পর্বতারোহী হয়ে থাকেন তাহলে আপনি ট্রেক করার জন্য সর্বপ্রথমেই চোখ দেবেন উন্নতমানের বিলাসবহুল সাজসরঞ্জামের দিকে কিন্তু সত্যি বলতে এত দাম দিয়ে এগুলো কেনার কোনো মানেই হয় না। কাঠমুন্ডু থেকে পোখারা পর্যন্ত এমন অসংখ্য জায়গা আপনি পাবেন যেখানে এগুলো আপনাকে ভাড়াতেই দেবে।

সেখানেই পেয়ে যাবেন এক জোড়া বলিষ্ঠ হাইকিং বুট, আরামদায়ক একটি ব্যাকপ্যাক এবং একটি স্লিপিং ব্যাগ। বছরের যে সময়টাতেই পর্বতে আরোহন করেন না কেন সাথে অবশ্যই সানগ্লাস, সানস্ক্রিন এবং লিপ বাম থাকা চাই৷ উষ্ণ, ওয়াটারপ্রুফ একজোড়া হাতমোজাও বেশ প্রয়োজনীয়।

প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় একটা মেডিকেল কিটও রাখবেন যেখানে উচ্চতা ভীতি দূর করার ওষুধ (ডায়ামক্স), ফোস্কা প্রতিকারক মলম, ইমুডিয়াম, এন্টিসেপটিক ক্রিম, পানি বিশোধক ট্যাবলেট এবং স্যালাইন থাকবে। সিংহভাগ পর্যটকই হিমালয়ে বিপদমুক্ত থেকে ঘোরাঘুরি করেন।

আর আপনি যদি এভারেস্ট জয়ের অদম্য ইচ্ছা মনের মধ্যে পুষে রাখেন তাহলে অন্নপূর্ণা ট্রেইল আর পোখারার চারপাশটা আগে আগেই ঘুরে রাখুন। হিমালয় নিশ্চয়ই আপনাকে প্রতিশ্রুতি দেবে আপনার জীবনের সেরা এডভ্যাঞ্চারটি দেওয়ার জন্য।

Share:

Leave a Comment