ভূমি স্বর্গ কাশ্মীর ভ্রমণ পরিকল্পনা
কাশ্মীর হিমালয়ান পর্বতমালার সবচেয়ে বড় উপত্যকা ,কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ । মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর কাশ্মীরকে প্রথম তুলনা করেছিলেন স্বর্গের সঙ্গে। তাঁর আকুল আকাঙ্ক্ষা ছিল কাশ্মীরের তৃণভূমিতে মৃত্যুবরণ করার। তিনি ফার্সি ভাষায় বলেছিলেন, ‘আগার ফেরদৌস বে-রোহী যামীন আস্ত্। হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্। অর্থাৎ পৃথিবীতে কোনো বেহেশত থেকে থাকে, তাহলে তা এখানে, এখানে, এখানে। মোঘল সম্রাটরা দিল্লীর গ্রীষ্মের তাপদাহ থেকে নিস্তার পেতে অবকাশ যাপনের জন্য ছুটে আসতেন কাশ্মীরে। চশমাশাহী, পরিমহল, শালিমার, নিশাত, ভেরি নাগ ইত্যাদি তারই স্বাক্ষ্য বহন করছে। শুধু কি মোগল বাদশারা ? বর্তমানে সমস্ত পৃথিবী থেকেই ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা ভূস্বর্গ কাশ্মীর দেখার জন্য প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন এখানে । তো চলুন আমরা জানার বুঝার চেষ্টা করি বাংলাদেশ থেকে এই ভুস্বর্গে আমরা কিভাবে সহজে এবং কম খরচে ঘুরে আসতে পারি ।
কাশ্নীর যাবার উপযুক্ত সময় কখন : কাশ্মীর ঘোরার উপযুক্ত সময় এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। তবে কাশ্মীরের পুরো রুপ দেখতে চাইলে আপনাকে অন্তত তিনবার যেতে হবে। — এপ্রিল থেকে মে বসন্তকালঃ এই সময় ফুলে ভরা ভ্যালী। টিউলিপ ফুলও দেখতে পারবেন। আর শীতের পরপরই তাই Snow ও অনেক। — সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর শরৎকালঃ এই সময়ে Snow কিছুটা কম থাকবে। তবে উপরের দিকে পাওয়া যাবে। যেমন, গুলমার্গ গন্ডোলার ২য় ফেজে, সোনামার্গের থাজিওয়াস হিমবাহে। এই সময় ফল পাওয়া যাবে। গাছে গাছে আপেল ঝুলে থাকবে। আর তার সাথে চিনার গাছের রঙ্গিন রুপ। — ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি শীতকালঃ এই সময়ে দেখবেন সাদা শুভ্র পাহাড়। চারিদিকে শুধু Snow, snow & snow. আর Snow fall তো আছেই। তবে শীতকালে অসুবিধাও অনেক। শীতের অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে, রাস্তা-ঘাট বন্ধ থাকে ফলে অনেক জায়গায় যেতেই পারবেন না। এমন কি আপনার আটকে পড়ার চান্স অনেক বেশী। তাই সবদিক বিবেচনা করলে এবং আপনি যদি একবার যেতে চান, তাহলে এপ্রিল-মে উপযুক্ত সময়।
বাংলাদেশ থেকে কাশ্মীর যাবো কিভাবে ? — প্রথমে ট্রেনে কিভাবে যেতে হবে সেটা বলি , ট্রেনে যেতে চাইলে আপনাকে ঢাকা থেকে কলকাতা কলকাতা থেকে জম্মু যেতে হবে এবং সেখান থেকে গাড়ী করে শ্রীনগর। কলকাতা থেকে জম্মু যাওয়ার দুটি ট্রেন আছে। হিমগিরি ও জম্মু তাওয়াই, হিমগিরি সপ্তাহে ৩ দিন (মঙ্গল, শুক্র ও শনিবার) রাত ১১:৫০ টায় হাওড়া থেকে জম্মুর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ৩৫ ঘন্টা ৩৫ মিনিট। আর জম্মু তাওয়াই প্রতিদিন চললেও সময় একটু বেশী লাগে। অনেকে আবার ট্রেনে দিল্লী গিয়ে আগ্রার তাজমহল এগুলো ঘুরে কাশ্মীর যায় সেক্ষেত্রে আপনি দিল্লী চলে যান সেখানে ঘুরে তারপর জম্মুর এভেইলেভেল ট্রেন পাবেন । কলকাতা থেকে দিল্লি যাবার ট্রেন সবসময়ই পাবেন । কলকাতা থেকে জম্মু পর্যন্ত নন এসি স্লিপার ১৫০০-১৬০০/- বাংলাদেশী টাকায় আর এসি ৩৩০০-৩৫০০/-টাকা পড়বে। এরপর জম্মু থেকে শ্রীনগর গাড়ীতে ৬ জনের দল হলে পার হেড ৬০০-৮০০/- টাকায় হয়ে যাবে। জম্মু থেকে শ্রীনগর যেতে সময় লাগবে ৮-১০ ঘন্টা। ট্রেনের টিকেট দেশের যেকোন ট্রাভেল এজেন্সি থেকে অগ্রিম কেটে রাখতে পারেন অথবা গিয়েও কাটতে পারেন যেমন আপনার খুশি । — এবার আসি বিমানে যারা যেতে চান তারা কি করবেন কাশ্মীর যেতে হলে ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক বিমানে প্রথম যেতে হবে দিল্লি ইন্ধিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সেখান থেকে শ্রীনগর। অথবা ঢাকা থেকে কলকাতা যাবেন ট্রেনে বা বাসে পরে সেখান থেকে ডোমেস্টিক বিমানে জম্মু অথবা শ্রীনগর বিমানবন্দরে যাওয়া যাবে। কলকাতা থেকে সরাসরি শ্রীনগরে কোনো ফ্লাইট নেই তাই, দিল্লি হয়ে যেতে হয়। বিমানের টিকেট শ্রীনগর পর্যন্ত ৮০০০/- ১৫,০০০/- টাকা বিভিন্ন মৌসুমের উপর নির্ভর করবে। তবে বিমান খরচ কমানোর সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হলো বাংলাদেশের কোন ট্রাভেল এজেন্সি দিয়ে যত আগে সম্ভব ১/২ মাস আগে বিমানের টিকেট কেটে রাখা এতে সস্তায় বিমানের টিকেট পাওয়া যায় ।
কোন_স্থল_বন্দর_দিয়ে ঢুকবেনঃ দরশনা বেনাপোল দিয়ে ঢোকায় ভাল হবে। ১।বেনাপোল (বেনাপোল-পেট্রাপোল) : ঢাকা থেকে যেকোন বাসে পৌছে যান সরাসরি বেনাপোল । সীমান্তে দুই দেশের ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আরেকটি অটোরিকশায় ২০ রুপি নেবে বনগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত। বনগাঁও থেকে কলকাতার ট্রেন পাওয়া যায় প্রায় প্রতি ঘণ্টায়ই। টিকেট হবে ২০-৩০ রুপি। এছাড়া গ্রিনলাইন শ্যামলী সহ বেশকিছু বাস সার্ভিস সরাসরি কলকাতা পর্যন্ত যায় ।। ট্রেনেও ঢাকা থেকে যেতে পারেন সরাসরি কলকাতা ভাড়া পড়বে ৬৫০ টাকার মতো ।। কমলাপুর বা চিটাগাং স্টেশনে টিকেট পাবেন । কলকাতা হয়ে যাওয়াটা বেস্ট কারণ কলকাতাটাও দেখা হয়ে গেলো ২। দর্শনা – গেদে দিয়ে যদি যেতে চান তাহলে প্রথমে দর্শনা হল্ট স্টেশনে যেতে হবে। এখান থেকে চেকপোস্ট ৫ কিঃমিঃ এর মত। আপনি অটোরিকশা বা ভ্যানে চলে যান। ভারতের দিকের চেকপোস্ট গেদে রেল স্টেশনেই। এখান থেকে ১ ঘন্টা ৩০ মিঃ পরপর ট্রেন আছে। ভাড়া শেয়ালদহ পর্যন্ত ৩০ রুপি ও দমদম জং ২৫ রুপি। আপনি যদি বিমানে শ্রীনগর যান তাহলে দমদম নামবেন আর ট্রেনে গেলে শিয়ালদহ। সীমান্ত পেরিয়ে আপনার ডলারগুলো রুপিতে কনভার্ট করে নিবেন তবে কনভার্ট করার আগে অনলাইনে রেটটা জেনে নিবেন ।
থাকার ব্যবস্হা ? এবার দেখি থাকার ব্যবস্হা কি , থাকার জন্য প্রচুর হোটেল পাবেন কাশ্মীরে । সাধারণ মানের ব্যাচেলার থাকার জন্য হোটেল ৫০০-৬০০ টাকার মাঝে পাবেন । আর ফ্যামিলির স্ট্যান্ডার্ট হোটেল ১২০০-১৫০০ রুপির ভিতরে পাবেন । এর চেয়ে দামী দামী হোটেল পাবেন । আপনার বাজেট ও পছন্দ অনুযায়ী নিয়ে নিন হোটেল ।
কাশ্মীরে কোথায় কোথায় ঘুরবেন : কাশ্মীর পুরোটাই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য স্বর্গ । তারপরও ভিন্ন ভিন্ন লোকেশনে বেশ কিছু টুরিস্ট স্পটের তালিকা দিলাম । ১। শ্রীনগরে- মোঘল গার্ডেন, টিউলিপ গার্ডেন, ডাল লেক ও নাগিন লেকে শিকারা রাইড, হযরত বাল মসজিদ। ২। গুলমার্গেঃ গন্ডোলা (ক্যাবল কার), গলফ কোর্স, বাবা ঋষির মাজার,আফারওয়াত পিক, সেন্ট ম্যারী চার্চ। ৩। পেহেলগামঃ লিদার নদী, বেতাব ভ্যালী, আরু ভ্যালী, চন্দন বাড়ী এবং ঘোড়ায় ট্রেকিং করে পেহেলগাম ভিউপয়েন্ট, মিনি সুইজারল্যান্ড খ্যাত বাইসারান, ধাবিয়ান, কাশ্মীর ভ্যালী ভিউপয়েন্ট, কানিমার্গ, Waterfall, তুলিয়ান ভ্যালী ইত্যাদি। পায়ে হেঁটেও যাওয়া যায়। তবে বৃষ্টি হলে রাস্তা অনেক পিচ্ছিল থাকে। আর তাছাড়া ঘোড়ায় চড়লে একটু Adventure ও হয়। ৪। সোনামার্গ : প্রধানত থাজিওয়াস হিমবাহ। এছাড়া সিন্ধ নদী, Waterfall, বাজরাঙ্গী ভাইজান ও রাম তেরে গঙ্গা মেরে ছবির স্যুটিং স্পট। এবার আমরা দেখি এই প্রধান স্পটগুলো ঘুরে দেখার জন্য কিভাবে প্লান করা যেতে পারে দিন-১ঃ শ্রীনগর দিন-২ঃ পেহেলগাম (পেহেলগামে রাতে থাকবেন) দিন-৩ঃ পেহেলগাম (পেহেলগাম দেখা শেষ করে শ্রীনগরে আবারও ফিরে আসবেন) দিন-৪ঃ গুলমার্গ (গুলমার্গ দেখে শ্রীনগরে ফিরে আসবেন) দিন-৫ঃ সোনামার্গ (রাতে সোনামাগার্গের হাউজ বোটে থাকবেন) এভাবে প্লান করলে আপনি ৫ দিনে মোটামুটি কভার করে ফেলতে পারবেন তবে আমি শুধুমাত্র একটা গাইডলাইন দিয়ে দিলাম আপনি আপনার মতো কাস্টমাইজ করে নিতে পারেন । সব জায়গাতেই রিজার্ভ গাড়ী নিতে হবে আপনাকে চারজন বসার মতো গাড়ীগুলো ১২০০-১৫০০ নিবে এর চেয়ে বড়গুলো ২-৩ হাজার নিবে আপনি যাচাই করে দাম দর করে গাড়ী ঠিক করবেন ,কিন্তু এরপরও কথা আছে কাশ্মীরে এক জোনের গাড়ী আরেকজোন পর্যন্ত আপনাকে নিয়ে যাবে কিন্তু টুরিস্ট প্লেসগুলো দেখার জন্য আবার গাড়ী নিতে হবে ওখানকার যেমন পেহেলগাম ও সোনামার্গে রিজার্ভ গাড়ীতে যাওয়ার পর আবারও ওখানকার গাড়ী ভাড়া করতে হবে। যেমন পেহেলগামে থেকে আরু ভ্যালী ও চন্দনবাড়ী যেতে ভাড়া ১৬০০ রুপি। পেহেলগামে ৬ পয়েন্ট (পেহেলগাম ভিউপয়েন্ট, ধাবিয়ান, বাইসারান, কানিমার্গ, কাশ্মীর ভ্যালী ভিউ পয়েন্ট, waterfall) ঘোড়ায় প্রতিজনের ১৫০০-২০০০ রুপি। এদিকে সোনামার্গ থেকে থাজিওয়াস হিমবাহ গাড়ী ভাড়া ২৫০০- ৩৫০০/- রুপি। কি বুঝে গেলো ব্যাপারটা ?
কাশ্মীরে ঘুরে আসতে খরচ কেমন হবে সত্যি বলতে খরচটা নির্ভর করে আপনার উপরে আপনি কতটা খরুচে বা বিলাসীতা প্রিয় এর উপর । তারপরও আমি একটা আইডিয়া দিয়ে দিচ্ছি ,এখান থেকে আপনি ভালো আইডিয়া পাবেন ।
১। বাংলাদেশ -কলকাতা (আসা যাওয়া)=ট্রেনে ঢাকা টু কলকাতা ৬৫০ টাকা করে আসা যাওয়া রাফ হিসেব ১৫০০ টাকা ।। অথবা বাসেও বর্ডারে গিয়ে সেখান থেকে কলতাকা চলে যেতে পারেন । ২। কলকাতা- জম্মু= (ট্রেন+ খাওয়া)- ১৬০০+৬৫০=২২৫০x২= ৪৫০০ টাকা আসা যাওয়া ৩। জম্মু- শ্রীনগর= ৭৫০/-x২= ১৫০০/- আসা যাওয়া । ৪। কাশ্মীরে (সবকিছু) = ২০,০০০ টাকা ,থাকা খাওয়া ঘুরাঘুরি প্রতিজন । তো রাফ হিসেব করলে আপনার বাজেট ২৫+ হাজার টাকায় ঘুরে আসতে পারবেন ।।
এটা একটা রাফ হিসেব খরচ বাড়তেও পারে আবার আপনি চাইলে কমতেও পারে নির্ভর করে আপনার উপর ।। আমি শুধু একটা ধারণা দিলাম । এবার কিছু দরকারী টিপস শেয়ার করি ১। কাশ্মীর পর্যটন এলাকা। এখানে সবকিছুর দাম বেশী চাইবে। তাই যাই করুন না কেনো, দরদাম করতে ভুলবেন না। তবে ভদ্রভাবে কথা বলবেন অবশ্যই। ২। এখানকার খাবারে মশলা বেশী থাকায় আমরা বাংলাদেশীরা খেতে সমস্যা হয়। ভাতের দামও অনেক বেশী । তাই রুটি খেলে খরচ কম হবে এবং খাওয়াও যাবে। ৩। সন্ধ্যা ৮টার পর হোটেলের বাইরে অযথা ঘোরাফেরা করবেন না। আর হ্যাঁ, কেনাকাটা করতে চাইলে রাত ৮ টার মধ্যেই সারুন। কারন রাত ৮ টার পর দোকান বন্ধ হয়ে যায়। ৪। যেখানেই যান পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে রাখুন। ৫। কাশ্মীর মুসলিম প্রধান (৯৯%)। তাই মুসলিম হলে পরিচয় দিলে সুবিধা পাবেন। আর একটি কথা কাশ্মীরীরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে খুব পছন্দ করে এবং সাকিব আল হাসানের খুবই ভক্ত। তাই বাংলাদেশী পরিচয় দিন নির্দিধায়। ৬/ট্রাভেল ট্র্যাক্স ৫০০ টাকা যাবার আগে সোনালী ব্যাংকের যেকোন শাখায় দিয়ে দিলেই হবে তাহলে সীমান্তে আর এই ঝামেলাটা থাকলোনা ।।