মেঘের দেশ সাজেক

অনেকবার ডেইট চেঞ্জ করতে করতে কিভাবে যেন হুট করেই রওনা দেওয়া। ঢাকা থেকে আমি যাচ্ছি, বাকিরা সিলেট থেকে। চট্টগ্রামে গিয়ে একসাথে রওনা দিব মেঘের দেশে। কপালের লিখা কে খন্ডাবে!! ৩ ঘন্টা দেরী করে যখন চট্টগ্রামে পৌছালাম ততক্ষ্ণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বহুকষ্টে খাগড়াছড়ির বাসের ইঞ্জিনের উপর ঠাই হল আমাদের। সকালের এস্কোর্ট তো মিস হলই বিকালেরটাও ধরতে পারব কিনা তার নিশ্চয়তা কে দেবে তারওপর যদি বাস আবার নস্ট হয়!! কপালে যেদিন দুঃখ আসে, সেদিন সব দিক দিয়েই আসে।
আমরা যখন দিঘীনালায় পৌছালাম ততক্ষ্ণে সূর্যমামার ঘুমাবার সময় হয়ে এসেছে। এস্কোর্ট তো মিস হলই, তাইলে এখন উপায়!! এক সিএনজি ড্রাইভার বলল সে নাকি নিয়ে যেতে পারবে। তো উঠে পড়লাম আমরা। যা আছে কপালে। শেষবিকালে আমরা পাহাড়ি ওই স্বর্গের রাস্তাটা ধরে যেন স্বর্গেই যাচ্ছি। চলে আসলাম বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্পে। দুর্ভাগ্যের ষোলকলা পূর্ণ হল। আমাদের এই রাতের বেলা কোনভাবেই যেতে দিবে না। আর মাত্র ৩৭ কিমি পর আমাদের গন্তব্য। ২৪ ঘণ্টার কষ্ট বৃথা!! তো কি আর করা । দিঘীনালায় ফিরে আসা। আর পরদিন সকালের জন্য অপেক্ষা।
সকাল হল। আমাদের যাত্রা আবার শুরু হল। রাতের ঘুমে শরীর এখন চাঙা। গতকালের লাস্টের আমরা আজ সবার আগে বাঘাইহাট। পথে হাজাছড়া দেখে এসেছি। বলা যায় পানিশূন্য হাজাছড়া। সাড়ে দশটায় এস্কোর্ট ছাড়ার কথা এগারোটা বেজে গেল তাও ছাড়ছে না! আমাদের যেন চিন্তা নাই, হাতে চায়ের কাপ নিয়ে জমিয়ে ক্যারাম খেলছি বাঘাইহাট বাজারে। 
এবার আর কোন বাধা নাই বলা যায়। স্বর্গের দ্বার আজ আমাদের জন্য উন্মুক্ত। আদিবাসী বাচ্চারা হাত নেড়ে স্বাগতম জানাচ্ছে আমাদের। এবার বুঝি দেখা মিলবে সাজেকের। কিন্তু……
সাজেকে যাওয়ার সর্বশেষ পাহাড়টার খাড়া অংশটুকু পার করতে আমাদের সি এন জি এর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। নেমে কিছুটা পথ তাই হাটতে হল অভিকর্ষের বিপক্ষে।
অবশেষে পৌছালাম। ঠিক করেছিলাম কোন কটেজে উঠব না। একেবারে আদিবাসীদের সাথে উনাদের বাড়িতেই থাকব, উনাদের খাবার খাব। খুব কাছ থেকে দেখব তাদের জীবনযুদ্ধ। দিদিকে কল দিলাম। উনি এসে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে গেল ,যেন বাড়িতে মেহমান এসেছে। তারপর নিয়ে গেল মাচাং এ যেখানে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। মাচাং এর বারান্দায় গিয়ে সামনে যা দেখলাম তার কাছে আমাদের দুদিনের সব পরিশ্রম একেবারে নাই হয়ে গেল। এ আমার বাংলাদেশ। <3
রেস্ট নিয়ে বিকালে বের হলাম। হ্যালিপ্যাডে সূর্যাস্ত দেখলাম। আর একটু পর আকাশ জুড়ে কোটি তারার মেলা। পুরোটা আকাশ গঙ্গা। কতক্ষ্ণ আকাশভরা তারার নিচে শুয়ে ছিলাম জানি না। পেটের রাক্ষসটা জানান দিল তার অস্তিত্ব। ফিরে আসলাম মাচাং এ। আজ রাতের মেনু ব্যম্বু চিকেন, বাঁশের মধ্যে রান্না করা পাহাড়ী চালের ভাত, আলুভর্তা,ডাল। যেন অমৃত। খেয়েদেয়ে বারান্দায় বসে মেঘের সমুদ্র দেখা। যেন স্বপ্নের মধ্যেই বেঁচে থাকা।
রাত পোহালো। ভোর হলো। আমাদের সামনেই মেঘের সমুদ্র থেকে যেন সূর্যটা উকি দিল। খেয়েদেয়ে যাত্রা করলাম কংলাক এর দিকে। সূর্যের তেজ তখন পুরোপুরি। একঘন্টা পর পৌছালাম কংলাকে। আমরা তখন সবার চেয়ে উপরে। আদিবাসী মেয়েরা বসে কাপড় বুনছে। আর পিচ্চিগুলা বেশি জোস। আমাদেরকে ওদের ভাষা শিখাচ্ছে। শুনলাম এক ঝর্ণার কথা। দেড় দুঘন্টার পথ ওখান থেকে। কয়েকজন মানা করল যেতে। কিন্তু যেতে তো হবেই। এক পিচ্চিকে (ওর নাম মওনা) গাইড বানিয়ে রওনা দিলাম। মওনার সাথে ওর দু একজন বন্ধুও গেল আমাদের সাথে। জঙ্গলের মধ্যে পথ বানিয়ে আমরা যাচ্ছি তো যাচ্ছি। পথের শেষ বলে যেন কিছুই নেই। একটুপর ঝর্ণার শব্দ শুনতে পেলাম। নভেম্বরেই এত পানি!! বর্ষায় না যেন কেমন হয়! আমরা ছাড়া আর কেউ নাই এখানে। সূর্যের আলো বহুকষ্টে আসে যেন। শুরু হল আমাদের ঝাপাঝাপি। ফিরে এলাম কংলাকে। এখান থেকে সাজেকে যাওয়ার এনার্জি নাই কারো। একটা গ্রুপ তাদের গাড়ি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গেই তাদের গাড়িতে করে সাজেকে চলে আসলাম। ধন্যবাদ তাদের।
মাচাং এ আসলাম শেষ বিকালে। গোসল সেরে খেয়েদেয়ে এক ঘুম। যা পরিশ্রম গেল ! রাতে বের হয়ে হাটাহাটি করে আসলাম। এবার ফেরার পালা। এই স্বর্গ ছেড়ে চলে যেতে হবে! রাতের খাবার খেয়ে দিদির সাথে গল্প করতে বসে গেলাম। দিদি আরেকটা দিন থাকতে বলল। দুইদিনে আমাদের যেন আপন করে নিয়েছে। সম্পর্ক্টা আপনি থেকে তুই,তুমিতে চলে এসেছে। বায়না করলাম আমাদের জুম চাষের জমিতে নিয়ে যেতে হবে, সাথে আরেকটা ঝর্ণায় যেখানে মাছ ধরা যাবে। দিদি রাজি হল আর আমরা আমাদের ড্রাইভারকে কল দিয়ে আরেকটা দিন পরে আসতে বলি। শুয়ে শুয়ে আবারো ভোরের অপেক্ষা করতে থাকি।
পরদিন দিদি সময় দিল ৯ টায়। তার আগে বের হলাম আমরা। নাস্তা করে হাঁটাহাঁটি। বিচ্ছুরানী ও তার দলবলের সাথে দেখা। খেলছে তারা বালু, পাতা, ইট দিয়ে রান্না রান্না। একটা পাতায় আমাকে খেতে দিল। কিচ্ছুক্ষ্ণ পর দেখি হাতে বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে সবাই। স্কুল শুরু হয়নি এখনো। এত সুন্দর একটা পরিবেশে স্কুল! খেলার ছলে ওদেরকে দিয়েই ওদের স্কুল মাঠে পড়ে থাকা কাগজ, প্লাস্টিক পরিষ্কার করালাম। যে বেশি কাগজ পরিষ্কার করতে পারবে সে তত বেশি চকলেট পাবে। খুব আগ্রহ নিয়ে সবাই নেমে গেল মাঠ পরিষ্কার করতে। (যদিও ময়লাগুলার বেশিরভাগই আমার আপনার ফেলা )
নয়টা বাজল। দিদির সাথে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। পৌছে গেলাম জুম চাষের জায়গায়। পাহাড়ী সবজি ,শাক তোলা হল ঝুড়ি ভরে। ঝিরিপথে হাটতে হাটতে , পিছলে পড়তে পড়তে এক ঝর্ণার কাছে পৌছালাম। সামনে যাওয়ার আর রাস্তা নাই। এখানেই শুরু হলো আমাদের চিংড়ী শিকার। একবোতল চিংড়ি আর চার পাঁচটা কাকড়া ধরে ফেরার পথ ধরলাম। কিন্তু বিধিবাম।
এবার দিদিও রাস্তা ভুলে গেলেন! এপথ ওপথ করতে করতে নতুন রাস্তাও বানিয়ে ফেলল। সামনে একটা জুমঘর। ওখানে বসে চিংড়িগুলো ভাজা হল। সে কি স্বাদ!! চারপাশে পাহাড়, সবুজ আর নিরবতা!! বারবিকিউ শেষ হল। আমাদের রেস্টও হল। মাচাং এর দিকে রওনা দিলাম। পথে একটা কূপ। এখান থেকে খাবার পানি নিয়ে যান দিদিরা। এখানেই গোসল করে নিলাম। মাচাং এ এসেই সব চিৎপটাং । আর দিদি আর মাসীমা রান্না শুরু করল। একটু পর সামনে হাজির হল নিজেদের তুলে আনা শাক সবজি। তেল ছাড়া রান্না। পাতিলের বদলে বাশে রান্না হয়। তার কি স্বাদ। খেতে খেতে প্যান্টের বেল্ট ঢিলা করা লাগে, তারপর হেলান দেওয়া লাগে, তাও খাওয়া শেষ হয় না।
সকালে গাড়ী আসবে। চলে যেতে হবে। দিদি মাসী আবার অগ্রীম নেমন্ত্রণ দিয়ে রাখলেন। পরেরবার আসলে নাকি সাজেক নদী দেখাতে নিয়ে যাবেন !!!!
সহজ সরল প্যাচহীন মানুষগুলো ৩ দিনেই একটা বন্ধনে আটকে দিয়েছেন যেন।
আমাদের সাজেক পর্ব শেষ হল। কিন্তু ট্যুরের এখনো বাকি আছে। এবার যাত্রা খাগড়াছড়ি। রাতের বাসের টিকিট করে সিস্টেম রেস্টুরেন্টে খেয়ে রওনা দিলাম রিছাং ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। স্লাইড দিতে গিয়ে একবার পিছলিয়ে পড়েও গেলাম। বড় দুর্ঘটনা না ঘটলেও কনুই হাটুতে ব্যথা পেলাম। আর প্যান্ট এর ১২টা বাজায় দিলাম!!! (ভাগ্যিস এক্সট্রা ছিল 😛 )
রিছাং এর পর আলুটিলা। সন্ধ্যা হয়ে এল। আমরা মশাল হাতে গুহায় প্রবেশ করলাম। যেন অন্য কোন জগতে চলে এসেছি। ২০ মিনিট পর ফিরে এলাম চেনা জগতে।
রাতে খাগড়াছড়ি শহরে ঘুরাঘুরি করে ৯ টায় বাসে উঠলাম। বাস ছাড়ল। পেছনে রেখে এলাম জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ৪টা দিন। আর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি সারাজীবন মনে রাখার মত হাজারো স্মৃতি।

খরচঃ তিনরাত সাজেকে ছিলাম। কটেজে না থাকা আর বাইরে হোটেলে না খাওয়ার জন্য খুবই অল্পতে ট্যুর শেষ করা সম্ভব হয়েছে।
তিন দিনের জন্য মাচাং এ ৩৫০০ লাগছে। ( যদিও দিদি ৩০০০ চেয়েছিল)
খাওয়া দাওয়া + যাতায়াত+ অন্যান্য সব মিলিয়ে পার পারসন ৫৩০০+ খরচ ।

**ছবির এই ঝর্ণাটারই দেখা পেয়েছিলাম কংলাক থেকে যাত্রা করে।
হ্যাপি ট্রাভেলিং 🙂

Post Copied From:Hasib Mehedi Porosh‎>Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment