আবার অন্নপূর্ণা হিমবাহে

সবারই জীবনে ছোট খাট অনেক স্বপ্ন থাকে। আমিও এর ব্যাতিক্রম নই। বরং আমার মনে হয় এই ছোট ছোট স্বপ্ন গুলোর জন্যই আসলে বেঁচে থাকা। এমনই ছোট্ট একটি স্বপ্ন ছিল একদিন হিমবাহের উপর হাঁটবো। হাঁটু পর্যন্ত পা নরম তুষারে দেবে যাবে, অনেক কষ্ট হবে তবুও এগিয়ে যাব। প্রতিক্ষণে হুশিয়ার থাকতে হবে, হয়ত আমার পায়ের নীচেই আছে ক্রেভাস – বরফের অতল ফাটল, এক মরণ ফাঁদ। যেদিকেই চোখ যাবে শুধুই সাদা আর ঠান্ডার রাজত্বকে জানত আমার এই স্বপ্ন পূরন হবে হিমালয়ে। তাও আবার অন্নপূর্ণা হিমবাহে। ২০১৪ সালে অন্নপূর্ণা ম্যাসিফে একটি পর্বতাভিযানে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখনই আমাদের অন্নপূর্ণা হিমবাহের উপর দিয়ে অনেকক্ষণ ট্রেক করতে হয়েছিল। তুষারে হাঁটার স্বপ্ন পূরণ হল ঠিকই কিন্তু খেসারত দিতে হয়েছিল পুরো অভিযান।

সেবার আসলে ভাগ্যটা আমাদের ভাল ছিল না। তা না হলে হঠাৎ করে কেনই বা বঙ্গোপসাগরে ডিপ্রেসন হবে আর তার প্রভাবে হাজার মাইল দূরের হিমালয়ে দিন রাত তুষারপাত হবে। যেই ঋতুতে তুষার পাব না বলে কিঞ্চিত মন খারাপ ছিল সেটাই পরিবর্তিত হয়ে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল।

প্রথমবারের মত নেপাল হিমালয়ে কোন অভিযানে গিয়েছিলাম, অভিজ্ঞতা খুব একটা মন্দ হয় নি। হিমবাহ ট্রাভার্স করে খাড়া একটি ঢাল ক্লাইম্ব করে বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছানো, হাটু সমান তুষার সরিয়ে তাবু পিচ করা, অন্নপূর্ণার দেয়াল থেকে নেমে আসা মুহুর্মুহু তুষারধস, রাতের পরিষ্কার আকাশে দেখা কোটি কোটি তারা মাঝরাতে ভয়ানক ঠান্ডায় শরীরের তীব্র আকুতি অগ্রাহ্য করে ওম ধরা স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেড়িয়ে আসাটাই পর্বতারোহণের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা বলে আমার মনে হয়। এরপর সেই ভারি এক মন ওজনের প্লাস্টিক বুট পা গলাতে গিয়ে কুস্তি লড়। জমে যাওয়া হাতের কাপতে থাকা আঙুল দিয়ে টাইট করে ফিতা বাধো। এরপির গাঢ় অন্ধকারে মাথায় হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে শেরপা ওয়াংচুর দেখানো পথে হাঁটতে থাকো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্বতারোহণ নিয়ে থাকা সকল ফ্যান্টাসি দূর হয়ে গেল। একসময় মনে হত গভীর তুষারে পা ডুবিয়ে হাটা বুঝি খুব রোমাঞ্চকর হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম কাজটি খুব কঠিন। শরীরের শক্তি মুহুর্তের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বারবার হাটু পর্যন্ত দেবে যাওয়া পা উঠিয়ে আরেক কদম সামনে ফেলতে দম বেড়িয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে অক্সিজেনের অভাব তো আছেই।

ধীরে ধীরে পুব আকাশে সূর্য উদয় হল। কমলা আলোয় ভরে গেল তুষারময় পর্বত। ক্রমশ আমার শক্তি নিঃশেষ হতে লাগল আর আমি দল থেকে পিছিয়ে পড়তে লাগলাম। আরও ঘন্টা দুই পর আমরা হাইক্যাম্পের উপর একটা সমান জায়গায় পৌঁছলাম। এখান থেকেই মূল রিজলাইনের উঠার আগের স্নো ফিল্ড শুরু হয়েছে। এক কিলোমিটারের মত এই স্নোফিল্ড পেড়িয়ে রিজলাইনের খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে হবে। এরপির আরও প্রায় ৫ ঘন্টা ক্লাইম্ব করলে সামিটে পৌঁছানো যাবে।

আমরা যেই জায়গায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম আমি সেখানেই শুয়ে পড়লাম। আমার দেখাদেঝি রাব্বি ভাইও শরীর এলিয়ে দিল। আমাদের দুজনেরই মনে হল একটু ঘুমিয়ে না নিলেই নয়। বাকিরা এগিয়ে যাক। নিচে নামার সময় আমাদের ডেকে নিয়ে যাবে। ৫০০০ মিটার উঁচুতে বড় একটা পাথরের স্ল্যাবে দুজন আরামসে ঘুমিয়ে গেলাম। এত আরামের ঘুম বেইজক্যাম্পের তাবুতেও হয়নি।

অন্যদিকে দলের বাকিরাও খুব বেশীদূর যেতে পারেনি। গতদিনের তুষারপাতে সব ক্রেভাসগুলোর মুখ ঢেকে গেছে। হিডেন ক্রেভাস নেগোশিয়েট করে এগুতেই তাদের অনেক সময় লেগে গেছে। সামিটে যেতে অন্ধকার হয়ে যাবে বলে তারাও একপর্যায়ে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। এরপর আবার লম্বা একটা তুষারময় পথ পাড়ি দিয়ে আমরা বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছলাম। পা থেকে একমন ওজনের জুতা খুলতে পেরেই মনে হল, জীবন কত আরামের।

source: Salehin Arshady <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment