কীভাবে যাবেন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ খরচাবলি ও তথ্যবলি
শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা, একবার চোখে ধরা দিলে চোখ ফেরানো অসম্ভব। তাই যখনই কাঞ্চনজঙ্ঘা আমার হৃদয়ের মানসপটে ভেসে ওঠে ঠিক তখনই মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে শুধু হিমালয় পর্বতমালার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত বলে ভাবতে ইচ্ছে করে না বরং মনে হয় ” The Mighty Queen Of Ghorkhaland.” তাই এবারের ভ্রমণটা পুরোপুরি কাঞ্চনজঙ্ঘা কে কেন্দ্র করে সাজানো। আমাদের দু’জনের গ্রুপ, আমি আর ছোটবেলার বন্ধু Muhammad Al Imran Toney। ইমরান একদম Born traveler, হিন্দিতে দারুণ দক্ষ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে Tourist Guide হিসাবে চাকরি করেছে। তাই, আল্লাহ্ র উপর ভরসা করে আমরা দু’জনেই রওয়ানা হয়েছিলাম ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ তারিখে। Route Plan ছিল একদম কাঞ্চনজঙ্ঘা কে কেন্দ্র করে : দার্জিলিং-তিনচুলে-লাভা-রিশপ। রওয়ানা হওয়ার আগে অবশ্য Weather Forecast দেখে নিশ্চিত ছিলাম যে ১৯ ডিসেম্বর দার্জিলিংয়ের আকাশ পরিষ্কার থাকবে।
আমাদের বাড়ি থেকে দর্শনা-গেদে সীমান্ত ১ ঘন্টার পথ। তাই, দার্জিলিং যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের Route Plan ছিল দর্শনা-গেদে-কৃষ্ণনগর-শিলিগুড়ি-দার্জিলিং। বাংলাদেশের সীমানাতে আমরা কাউকে কোনো পয়সা দেই নি। তবে গেদে তে জনপ্রতি ৫০ রুপি দিয়েছিলাম। অতঃপর Immigration, Customs এর ঝামেলা মিটিয়ে আমরা গেদে থেকে ট্রেনে হাসখালি যায়। ভাড়া জনপ্রতি ১০ রুপি। হাঁসখালি স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচ হেঁটে কৃষ্ণনগরের বাসে উঠি। কৃষ্ণনগর বাসে এক ঘন্টার পথ। ভাড়া জনপ্রতি ১৮ রুপি। কৃষ্ণনগর থেকে শিলিগুড়ির জন্য বাস সাধারণত সন্ধ্যার দিকে ছাড়ে। তবে ” Night Queen” বাসের সেবা দারুণ। আমরা Sleeper নিয়েছিলাম। জনপ্রতি ৪০০ রুপি ভাড়া। পথে ফারাক্কা তে Jam এ না পড়লে একদম ভোরে পৌছে যাবেন শিলিগুড়ি। বাস যেখানে নামবে সেখান থেকেই দার্জিলিংয়ের জিপ পাবেন। ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ রুপি। শিলিগুড়ি তে বেশ কয়েকজন অতি উত্সাহী মানুষ আমাদের হোটেল বুকিং করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম দার্জিলিং পৌছে দেখে হোটেল ঠিক করবো। তাই, ওনাদের কে ধন্যবাদ জানিয়ে Shared জিপ এ উঠে বসলাম। প্রায় ১৬০ মিনিটের মতো সময় লাগলো দার্জিলিং পৌছাতে। দার্জিলিং পৌছে জামে সোজা জামে মসজিদের পাশে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল “ইসলামিয়া খাবার হোটেলের” পাশে থাকা। খুঁজতে খুঁজতে পেলাম ” Hotel Mount Pleasant.” দার্জিলিং এ হোটেলে দুইটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত : সার্বক্ষণিক গরম পানির ব্যবস্থা, দ্বিতীয়ত : রুম হিটার। আমরা অবশ্য দ্বিতীয় টা পাই নি। “Hotel Mount Pleasant” খুব Gorgeous কোনো Hotel নয় তবে ৮০০ রুপি Per night অনুযায়ী দুর্দান্ত একটা Hotel. সবচেয়ে ভালো লেগেছিল ওনাদের আন্তরিকতা। হোটেল থেকেই আমাদের Local Tourist Guide ঠিক করে দিল। জনপ্রতি ৬০০ রুপি। Tour Plan টা ছিল রাত ৪ টায় হোটেলের সামনে গাড়ি আসবে। অতঃপর টাইগার হিল-ঘুম মনেস্ট্রি-বাতাসিয়া লুপ দেখে হোটেলে ফিরবো। অতঃপর নাশতা করে রক গার্ডেন। ফিরে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে Japanese Temple-তেনজিং রক-টি গার্ডেন। আমাদের ভাগ্য দারুণ ছিল। তাই দার্জিলিং যাওয়ার পথেই কাঞ্চনজঙ্ঘা র দর্শন পেয়েছিলাম। আর পরের দিন ত অসাধারণ ! টাইগার হিল থেকে যখন দেখছিলাম তখন মনে হচ্ছিল নিচে যেন মেঘের সমুদ্র। আর তার ভেতর থেকে সূর্য উদিত হলো। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা ধীরে ধীরে রক্তিম আভায় আলোকিত হয়ে লালচে বর্ণ ধারণ করে মুগ্ধ করছিল উপস্থিত সবাইকে। উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে বলে উঠলো “Welcome.” অতঃপর কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ঘুম মনেস্ট্রি হয়ে বাতাসিয়া লুপ। বাতাসিয়া লুপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা কে দেখার পর মনে হলো “জীবন সার্থক।” অতঃপর বাতাসিয়া লুপ থেকে বের হয়ে হোটেল। পথে অবশ্য দুইবার Vegetable মোমো খেলাম। প্রথমবার ঘুম মনেস্ট্রি থেকে বের হয়ে; দ্বিতীয়বার বাতাসিয়া লুপ থেকে বের হয়ে। অতঃপর হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বের হলাম রক গার্ডেনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু রক গার্ডেন আমাকে দারুণভাবে হতাশ করলো। ২০১২ সালে প্রথমবার দার্জিলিং যাই। তখনকার সাথে এখনকার রক গার্ডেনের বেশ পার্থক্য চোখে পড়লো। রক গার্ডেন এখন আর আগের মতো সুন্দর নাই। ফিরে এলাম রুমে। দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম গাড়ির জন্য। কিন্তু আমরা দু’জন ছাড়া আর কোনো Tourist নাই। তাই Programme cancelled. যেহেতু সবগুলো Spot ই আমাদের দেখা তাই হোটেল আর কেনাকাটা করে দার্জিলিং ভ্রমণ শেষ করলাম। পরের দিন সকাল ৮ টায় Check out করে দার্জিলিং মোটর স্ট্যান্ডে গেলাম। উদ্দেশ্য সকাল ৯ টায় তিনচুলের বাস ধরা।
তিনচুলে মূলত কারসিয়াং এর তকদা তে অবস্থিত একটা পাহাড়ি গ্রাম। দার্জিলিং মোটর স্ট্যান্ড থেকে একটার দিকে সরাসরি বাস যায়। তবে আমরা সকাল ৯ টার গাড়িতে উঠলাম। এটা তকদা পর্যন্ত যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৫৫ রুপি। প্রায় ৮০ মিনিটের মতো পাহাড়ি আঁকা-বাকা পথ ধরে তকদা পৌছায়। রাস্তার দু’পাশ ছবির চেয়ে ও বেশি সুন্দর। ঘন পাইন বনের সারি অসাধারণ। তকদা থেকে আবার একটা ছোট ট্যাক্সি ভাড়া করি। প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ। ভাড়া ১৫০ রুপি। তিনচুলেতে পৌছে প্রথমে গুরুং হোটেল পাই। কিন্তু ভাড়া ২০০০ রুপি Per night. ২০০০ রুপি আমাদের জন্য একটু বেশি হয়। তখন গুরুং এর ম্যানেজার ই আমাদের অবিরাজ হোমস্টে’র কথা বলেন। কিছুদূর এগিয়ে আমরা তিনচুলেতে অবিরাজ হোমস্টেতে উঠি। অবিরাজ হোমস্টে’র ভাড়া Per night ১০০০ রুপি। অবিরাজ হোমস্টে নিঃসন্দেহে অসাধারণ। প্রথমত : তাদের আন্তরিকতা, দ্বিতীয়ত : রুম থেকে অসাধারণ দৃশ্য, তৃতীয়ত : সার্বক্ষণিক গরম পানির ব্যবস্থা আর সবশেষে চমত্কার পরিপাটি অসাধারণ একটা রুম। তবে এখানে খাওয়ার খরচ জনপ্রতি ৬০০ রুপি (তিন বেলা খাবার সাথে স্ন্যাকস এবং বেড টি)। তিনচুলে যথেষ্ট Scatter তাই খাবার খরচ বেশি পড়াটা স্বাভাবিক। তবে খাবারের মান এবং Item নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তিনচুলে যদিও একটা পাহাড়ি গ্রাম তবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিরিবিলি সময় কাটাতে চাইলে এটা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তিনচুলেতে আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার ১৮০ ডিগ্রি View পাবেন। আর যদি সারাদিনের জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করতে চান সেক্ষেত্রে কমলা লেবুর বাগান, তিস্তা নদী সহ আরো বেশ কিছু স্পট ঘুরতে পারবেন। ট্যাক্সি ভাড়া পড়বে ২২০০ রুপির মতো। তিনচুলেতে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে প্রতিটি বাড়ি যেনো এক একটা ফুলের বাগান আর মানুষগুলো অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। আর পায়ে হাঁটা দূরত্বে কাঞ্চনজঙ্ঘা View পয়েন্ট আমার স্মৃতিতে আজীবন হিরণ্ময় দ্যুতিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে। তিনচুলে থেক আমরা লাভার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।সন্ধ্যায় ট্যাক্সি ভাড়া করি যেনো সকালে ট্যাক্সি র ঝামেলায় পড়তে না হয় । ভাড়া ৩০০ রুপি। আমাদের কে পাহাড়ের ঢালে যেখানে নামিয়ে দেয় ঠিক সেখান থেকে ই জনপ্রতি ১০০ রুপিতে কালিম্পং এর জিপ পেয়ে যায়।
কালিম্পং পৌছে আমরা লাভার জিপ ধরি। ভাড়া জনপ্রতি ১০০ রুপি। তবে কালিম্পং থেকে লাভার রাস্তা বেশ খারাপ। এক ঘন্টার কিছু সময় বেশি লাগে লাভা পৌছাতে। এখানে প্রচুর বাঙালি হোটেল আছে। আমরা ৯০০ রুপিতে ” Hotel Rais” নামের একটা বাঙালি হোটেলে উঠি। এখানেই খাওয়া র ব্যবস্থা ছিল। সবজি-ভাত ৭০ রুপি, আর ডিম খেলে অতিরিক্ত ২০ রুপি। লাভাতে বিকালে আমরা মনেস্ট্রি আর জঙ্গলে ঘুরে কাটাই। পরের দিন ভোরে আমরা রিশপ যায়। ট্যাক্সি ভাড়া ৯০০ রুপি। উদ্দেশ্য ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা তে সূর্যের আলোর Reflection দেখা (যদিও টাইগার হিলে দেখেছি)। এখান থেকে বেশ কিছু চূড়া দেখা যায়। রিশপ ঘোরা শেষে মন ভরলো না। বুঝলাম সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে। এর থেকে “Rachela Peak” এ যাওয়া better ছিল। মূলত লাভা এবং রিশপের মধ্যে তেমন পার্থক্য নাই। তবে আপনি যদি জঙ্গলে ট্রেকিং পছন্দ করেন তবে লাভা-রিশপ ট্রেকিং উপভোগ করবেন। রিশপ থেকে হোটেলে ফিরে সিদ্ধান্ত নিলাম আরেকটা স্পট দেখবো। ১০ কিলোমিটার দূরে ছিল “Changi Falls.” Check out ছিল ১১ টায়। তাই হোটেলে কথা বলে ৩০ মিনিটের মতো সময় চেয়ে নিলাম। সাথে সাথে জিপ ভাড়া করলাম। লাভা-Changi Falls ভাড়া ১৫০০ রুপি। ৪৫ মিনিটের মতো সময় লাগলো পৌছাতে। এরপর ১ কিলোমিটার নিচে নেমে পেলাম অসাধারণ রূপসী “Changi Falls.” শীতের আগমনে প্রকৃতি যখন বার্ধক্যে উপনীত ” Changi Falls” তখনো যেনো অনন্তযৌবনা ! Changi Falls সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল কারণ এর অন্য পাশেই কাঞ্চনজঙ্ঘা ! অপূর্ব ! Changi Falls যাওয়ার পথে অন্তত তিনবার কাঞ্চনজঙ্ঘা র অসাধারণ View পাবেন। অতঃপর কিছুটা সময় কাটিয়ে ফেরার পালা। আমরা যখন হোটেলে পৌছে রুমে ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত, আমাদের হোটেলের ম্যানেজার তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য শিলিগুড়ির খালি জিপ খুজতে লাগলেন। আমরা নিচে নামার আগেই তিনি একটা প্রাইভেট খুঁজে হোটেলের নিচে আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। ভাড়া : লাভা-শিলিগুড়ি মাত্র ৬০০ রুপি (জনপ্রতি ৩০০রুপি) !