সপ্নের দেশ ও নীল দেশের আন্দামান ও নিকোবর

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জটি ‘এমেরাল্ড আইলস’ নামেও জনপ্রিয়। তৎকালীন ‘কালাপানি’ অথবা সেলুলার জেল যা বর্তমানে এক মিউজিয়াম রূপে ভারতের এক সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থান হিসাবে গড়ে উঠেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে এটি জানা গেছে যে, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সর্বপ্রথম বসতি পাললিক যুগের মধ্যকালে গড়ে উঠেছিল।আন্দামানিরাই, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রথম অধিবাসী ছিল। এই দ্বীপপুঞ্জের প্রধান ভাষা হল নিকোবরী। তবে, আধিকারিক ভাষাগুলো যেমন হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলেগু ও ইংরাজী ভাষারও এখানে ব্যাপকভাবে প্রচলন রয়েছে।

১৮৫০ সাল পর্যন্ত, আন্দামানিরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করত; ১৮৫০ সালের পর এরা বাইরের দুনিয়ার সংস্পর্শে আসে।

নিকোবরীরা, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মূল অধিবাসী ছিল; তারা নিকোবর দ্বীপ সমূহে শোমপেনদের সাথে বসবাস করত।

অষ্টদশ শতাব্দীতে, ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর এই দ্বীপটি বিশ্বব্যাপী দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু, ব্রিটিশদের সময়কালে এটি ‘কালাপানি’ নামে কুখ্যাত ছিল কারণ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে, সেই অপরাধীদেরকে এখানে বন্দী বানিয়ে রাখা হত।

ব্রিটিশরা এই সুন্দর দ্বীপটিকে ‘বন্দী শিবির’-এ রূপান্তরিত করে তুলেছিল, এখানে অভিযুক্ত অপরাধীদের আজীবনের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখত।

কিন্তু আজকের দিনে, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের পর্যটনে সবচেয়ে সু-প্রতিষ্ঠিত স্থান হিসাবে গড়ে উঠেছে। এখানে অবস্থিত বেশ কিছু মনোমুগ্ধকর স্থান এখানকার পর্যটনকে অনেক উন্নত করেছে।

আন্দামান ও নিকোবর— দু’টো নামই এসেছে মালয় ভাষা থেকে।

আন্দামানিজ বা নিকোবরিজ ভাষা নয়, শুনতে অবাক লাগলেও এখানকার বহুল প্রচলিত ভাষা কিন্তু বাংলা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে হিন্দি।

নিকোবরের একটি ছোট্ট দ্বীপ কাটচাল। এই দ্বীপ শতাব্দীর প্রথম সূর্যদয় দেখেছিল।

পৃথিবীর বৃহত্তম সামুদ্রিক কচ্ছপের ‘বাড়ি’ এখানেই।

এখানকার উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে বিশ্বের বিচ্ছিন্নতম প্যালিওলিথিক উপজাতিরা থাকেন। বর্তমানে এঁদের সংখ্যা তিনশোর আশেপাশে।

এখানকার রাজ্যপশু ‘ডুগঙ্গ’। এদের ‘সামুদ্রিক গরু’ও বলা হয়। এরা খুবই শান্ত ও নিরামিষাশী। ‘ডুগঙ্গ’কে ‘সমুদ্রের পরী’ও বলা হয়।

‘পান্ডুনাস’ নামে বিরলতম একটি ফল পাওয়া যায় নিকোবরে। স্থানীয় মানুষদের কাছে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাদ্য।

বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মাছ ধরা নিষিদ্ধ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে।

আন্দামানের ব্যারেন দ্বীপে ভারতের একমাত্র সক্রিয় আগ্নেয়গিরিটি রয়েছে।

আন্দামানের বারাটাঙ্গ ভারতের একমাত্র এলাকা যেখানে কাদার আগ্নেয়গিরি রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকা থেকে প্রায় ১,২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং চেন্নাই থেকে ১,১৯০ কিলোমিটার পূর্বে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, বেশ কিছু আদিম উপজাতির বাসস্হান। আন্দমানের প্রধান দ্বীপপুঞ্জগুলি হল ল্যান্ড ফল দ্বীপপুঞ্জ, মধ্য আন্দমান, দক্ষিণ আন্দমান, পোর্ট ব্লেয়ার এবং ক্ষুদ্র আন্দমান। দক্ষিণ দিকে অবস্থিত নিকোবর-কার নিকোবর, বৃহৎ নিকোবর, চোয়ারে, তরসা, নানকওরি, কচল ও ক্ষু্দ্র নিকোবরকে নিয়ে গঠিত।

দ্বীপপুঞ্জের দুটি সমষ্টি, আন্দামান ও নিকোবর একটি গভীর দশ ডিগ্রি চ্যানেলের মাধ্যমে বিভক্ত রয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জগুলোর মধ্যে ১২-টি দ্বীপপুঞ্জ, বিশেষত কার নিকোবর প্রধানত উত্তর দিকে অবস্থান করছে, অন্যদিকে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত সর্ব্বোচ্চ দ্বীপটি হল গ্রেট নিকোবর, যেটি প্রায় জনমানব শূন্য। এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির রাজধানী হল-আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত পোর্ট ব্লেয়ার।

যদিও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলভুক্ত, তাদের ধর্মও যাই হোক না কেন, তারা যেকোনো ভাষা বা উপভাষায় কথা বলুক না কেন, তাদের সাংস্কৃতিক রীতিনীতিতে অনেক মিল রয়েছে।

আন্দামান ও নিকোবর সমাজের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন ধর্মের মানুষের একইসাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান। সাম্প্রদায়িক হিংসার কথা এখানে কখনও শোনা যায় নি। এখানকার ধর্মীয় উৎসবগুলিতে সকলে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্যে অন্তঃ-ধর্মীয় বিবাহের প্রথাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কি জন্য বিখ্যাত?
ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, এই স্থান হল ভাসমান পান্না দ্বীপ ও পাথরের একটি সমষ্টি। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জটি নারকেল ও পাম গাছ দিয়ে ঘেরা

সুন্দর সমুদ্র-সৈকত ও তার স্বচ্ছ নীল জল এবং তার জলের নীচে ডুবে থাকা কোরাল ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের অবস্থানের জন্য বিখ্যাত। ম্যানগ্রোভ সংযুক্ত খাঁড়ি বরাবর দূষণমুক্ত বায়ু এবং বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের দরুণ আপনি এখানকার প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যাবেন।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ
৫৭২-টি দ্বীপসমূহের সমষ্টি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং স্বচ্ছ জলোচ্ছাসের দরুণ যেকোনও প্রকৃতিবাদী ব্যাক্তির নিকট এটি স্বর্গের চেয়ে কম কিছু নয়। পর্যটকদের জন্য এই এলাকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় কিছু স্থান হল ঘন সবুজ অরণ্যে আচ্ছাদিত বিভিন্ন পার্বত্য এলাকা এবং সূর্য চুম্বিত সমুদ্র সৈকত। এই দ্বীপপুঞ্জ স্কুবা ডাইভিং, ট্রেকিং, শ্নরকেলিং, ক্যাম্পিং এবং অন্যান্য বিভিন্ন জল ক্রীড়ার ন্যায় দুঃসাহসিক কার্যক্রমের জন্যও সুপরিচিত।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি বিখ্যাত পর্যটন স্হলগুলো হল ন্যাশনাল মেমোরিয়্যাল, সামুদ্রিক যাদুঘর, নাভাল সামুদ্রিক যাদুঘর, স্মৃথিকা যাদুঘর, হাড্ডো জুওলোজিক্যাল গার্ডেন, কোর্বাইন’স কোভ ও অন্যান্য সৈকত এবং হামফ্রে গঞ্জ মেমোরিয়্যাল ইত্যাদি।

অন্যান্য আরোও কিছু আকর্ষণীয় স্থানগুলি হল- পোর্ট ব্লেয়ারে অবস্থিত আন্দামান ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স, এশিয়ার সর্ব বৃহত্তম ছাতাম শ্য মিল, চিড়িয়া টাপু, সামুদ্রিক যাদুঘর, রেড স্কিন দ্বীপ এবং হ্যাভলক। এই দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি রোমাঞ্চকর স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে- কোর্বাইন’স কোভ, ওয়ান্ডুর সৈকত, সিপিঘাট ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স, সিনকি দ্বীপ, জলি বয় দ্বীপ ইত্যাদি।

পরিবহন
আন্দামান ও নিকোবরের দ্বীপপুঞ্জগুলি দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন অংশের সাথে জলপথ ও বিমানপথের মাধ্যমে সুসংযুক্ত রয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জগুলির অভ্যন্তরে যাতায়াতের জন্য বাস এবং সড়ক পরিবহনের অন্যান্য মাধ্যমগুলোও রয়েছে। দ্বীপ হওয়ার দরুণ, এই স্থানগুলো রেলপথ মাধ্যম দ্বারা দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সংযুক্ত করা সম্ভব হয় নি।

পোর্ট ব্লেয়ারের বীর সাভারকর বিমানবন্দর, এই দ্বীপপুঞ্জগুলোকে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে বিমান মাধ্যম দ্বারা সংযুক্ত করেছে।

নৌপথ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত পরিবহন পরিষেবা হিসেবে কাজ করে। পোর্টব্লেয়ার, এই দ্বীপপুঞ্জের প্রধান বন্দর হিসেবে কাজ করে। রাজ্য পরিবহন ও বেসরকারি পরিবহন সংস্থাগুলির দ্বারা পরিচালিত বাস পরিষেবা ছাড়াও, এখানকার অধিবাসীরা ব্যাক্তিগত ট্যাক্সি ও অটো-রিক্সার ব্যবহার করেন। এমনকি তারা সহজ এবং দ্রুত ভ্রমণের জন্য মোটর-সাইকেল ও বাই-সাইকেলও ব্যবহার করেন।

Share:

Leave a Comment