ঝলমলে এক শহর জয়পুরে

জয়পুরের অনিন্দ্য সুন্দর স্টেশনের রিটায়ারিং রুমে ফ্রেশ হয়ে একটি গাড়ি ঠিক করা হলো ১,০০০ রুপীতে, সারাদিনের জন্য। জলমহল, আমের ফোর্ট, যন্তর মন্তর, লেদার ফ্যাক্টরি সহ মোটামুটি ১০টি স্পট আমাদের দেখাবে। আমাদেরও খুব বেশী সময় ছিল না হাতে। যেহেতু বাজেট এবং সময় দুটোই অল্প তাই আমাদেরও তেমন একটা বিশেষ কোনো চয়েজ ছিল না। আর জয়পুর নিয়ে যেহেতু আগে কোনো স্টাডি করা হয়নি তাই ড্রাইভারের উপরেই পুরো দিনের পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

যেহেতু আগের রাতে খুব ভালো আর মনের মতো কিছু খাওয়া হয়নি, রাতে হয়নি ভালো ঘুম তাই ড্রাইভারকে জানিয়ে রাখলাম সবার আগে যেন ভালো কোনো হোটেল দেখে থামায়, পেট ভরে সকালের খাবার খেতে হবে। ড্রাইভার কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্টেশনের অদূরের একটি হোটেলে গাড়ি পার্ক করালো। বেশ আরাম করে কেউ আলু পরাটা, কেউ পুরী আর ডালের তরকারী, কেউ চায়ের সাথে চাপাতি আর আমাদের ছটু ডিমের সাথে পাউরুটি দিয়ে নাস্তা শেষ করে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

শীতের দিনে আলো ঝলমলে সকাল সবার কাছেই বেশ প্রার্থিত হয়ে থাকে। কনকনে বাতাসে কিছুটা উষ্ণ পরশ একটা অন্য রকম ভালো লাগা তৈরি করে। একটা নরম কোমল আরামের অনুভূতি হয়ে থাকে। আমরা নাস্তা শেষ করে গাড়িতে ওঠার পরপরই শীতের কুয়াশা সরে যেতে লাগলো ঝলমলে রোদের আবির্ভাবে।

যেন রোদ নয়, রাজস্থানের জয়পুর শহরের রাজকীয় হাসি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। গাড়ির কাঁচের জানালা খুলে দিয়ে শীতের বাতাস আর উষ্ণ রোদের মিশ্র আলিঙ্গনে একটা ভিন্ন স্বাদের সুখানুভূতি উপভোগ করছিলাম।

১০ মিনিটের মতো চলার পরেই রাজপথের গোল চত্বরের মাঝে জয়পুরের স্থপতির স্ট্যাচু দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম, ড্রাইভার তার সাথে আমাদের পরিচিত করে দিল। আমেরের রাজা জয় সিং এই জয়পুরের প্রতিষ্ঠাতা, (ড্রাইভার থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে)। যদিও উইকিও তেমনই বলছে।

শীত সকালের ঝলমলে রোদে পুরো স্ট্যাচু, তার চারপাশের বেদী, কবুতরের ঝাঁক, ঝকঝকে সরকারী স্থাপনা চকচক করছিল সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে। আমরা ছবি তোলার জন্য এক মিনিটের জন্য গাড়ি থামালাম। ভালো লাগছিল খুব, এমন প্রাচীন একটা শহরে এমন আলো ঝলমলে সকালে সবকিছু অবলোকন করতে পেরে।

যন্তর মন্তর জয়পুর। ছবিঃ লেখক

রাজপথের দুই পাশে বাড়িঘর, পুরনো স্থাপনা, স্বচ্ছ পথের দুইপাশেই নানা রকমের ফুলের গাছ পুরো শহরটাকে যেন আরও বেশী আলোকিত আর সুসজ্জিত করে রেখেছে নিজের তাগিদে আর পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য। ভালো না লেগে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যাবে না কিছুতেই। সেই রাজা জয় সিংয়ের চত্বর, স্ট্যাচু ছাড়িয়ে একটি সিগন্যালে গিয়ে গাড়ি থেমে গেল। অথচ আর কোনো গাড়ি নেই, কোনো দিকেই।

চাইলেই চলে যাওয়া যেত সিগন্যাল না মেনেই। ড্রাইভারকে সে কথা বললেই, যেন আকাশ থেকে পড়লো। জয়পুরে কেউ নাকি কখনোই পথের নিয়ম, সিগন্যাল অমান্য করে না। এখানে তেমন রীতিই নেই। তাতে রাস্তা যতটাই ফাঁকা হোক না কেন! আমাদের দেশে এমনটা ভাবা যায়? ওদের নিয়ম নীতি আর রীতি জেনেই যেন রাজাদের দেশ রাজস্থানের প্রতি মুগ্ধতা বেড়ে গেল মুহূর্তেই।

সিগন্যাল ছেড়ে গাড়ি এগোতেই দূরে প্রাচীন কিন্তু বনেদী গেট চোখে পড়লো। সেই সাথে হালকা গোলাপি রঙের আভা। সেদিকে অবাক চোখে তাকাতেই ড্রাইভার জানালো সামনেই পিংক সিটি। ওয়াও, সবাই দারুণ উচ্ছ্বসিত আর উৎকণ্ঠিত আনন্দে উদগ্রীব হয়ে অধীর অপেক্ষা করতে লাগলাম জানালায় মুখ রেখে। কত নাম শুনেছি এই শহরের, এই শহরের এই অভিন্ন স্থাপনার, কত ছবি দেখেছি, টিভি, সিনেমা আর রঙ বেরঙের পোস্টারে বা ক্যালেন্ডারে। আর আজকালকার ফেসবুকের কল্যাণে তো নিয়মিতই দেখা যায় এই বনেদী শহরের অনন্য স্থাপনার বা শহরের কত শত ছবি।

এই সেই পিংক সিটি। দারুণ একটা শিহরণ অনুভূত হলো। এই সেই খ্যাতিমান শহরের বিখ্যাত পিংক সিটি। একদম আমাদের সামনে, চোখের সামনে বাস্তবে দেখছি। যেটা গতকালকেও ভাবিনি, সেই পিংক সিটির মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

পিংক সিটি ছাড়তে না ছাড়তেই আরও প্রাচীন আর বনেদী আর আরও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সামনে চলে এলো হাওয়া মহল! সবাই অভিভূত, অবাক আর বাকরুদ্ধ যেন নিমেষেই। হবেই বা না কেন? আমরা তো জানতামই না কবে আর কোথায় যাবো, কী কী দেখবো আর সেগুলো কেমন হবে আদৌ?

সেই তারাই যদি পেয়ে যায় এমন সব ইতিহাস, প্রাচীন সব স্থাপনা আর তাদের ঝলমলে হাসির বাস্তব ছবি একদম চোখের সামনে আর হাতের নাগালে তবে তো এতটুকু অবাক হওয়াই যায়, তাই না? আমরাও তাই হয়েছিলাম, এসব দেখে দেখে আর অভিভূত হয়েছিলাম প্রাচীন ইতিহাস সামনে দেখতে পেয়ে। আলাদা গল্পে বলবো পিংক সিটি আর হাওয়া মহলের গল্প।

এরপর আমরা সমতল ছেড়ে ধীরে ধীরে কিছুটা পাহাড়ি পথে চলতে শুরু করেছিলাম। এ এক অদ্ভুত পথ ছিল, যে রকম পথে আগে কখনো কোথাও যাইনি, দেখিনি উপভোগ করিনি। এটা জানতাম যে রাজস্থানের মরুভূমিময় একটি শহর এই জয়পুর। কিন্তু মরুভূমির দেখা পাবো না সেটাও জানতাম। কিন্তু যে পথে চলতে শুরু করেছি সেই পথেই পেয়েছিলাম অল্প হলেও কিছুটা মরুভূমির স্বাদ।

দুই পাশের পথ আলতো করে উঠে গেছে পাহাড়ি পথের মতো করে। যার চারদিকেই লাল আর ধূসর মাটির রুক্ষতা। কোথাও তেমন সবুজ ভূমি বা সবুজের আচ্ছাদন নেই। তবে হ্যাঁ এই মরুর পথের দুই পাশেই অবাক করার মতো ছিল কিছু দুর্লভ ফুলের মুগ্ধ করা হাসি, আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর সেই সাথে মরুভূমিময় ধুলোর আমন্ত্রণ।

তবে কেন যেন রাজস্থানের সেই লাল-হলুদ ধুলোও সেদিন ভালো লেগেছিল। ভালো লেগেছিল শীতের কনকনে বাতাসে সূর্যের উষ্ণতা, মরুর পথে পথে বর্ণীল ফুলের হাসি, গোলাপি শহর পিংক সিটির আমন্ত্রণ, হাওয়া মহলের স্বাগতম আর দারুণ ভালো লেগেছিল জলমহলের নিমন্ত্রণ সেই সাথে ছিল প্রাচীন আভিজাত্য যন্তর মন্তরের বিস্ময়। একে একে বলবো এই গল্পগুলোও।

সবকিছু মিলেই আমাদের দারুণ একটি দিন কেটেছিল ঝলমলে জয়পুরে।

Share:

Leave a Comment