গোমুখ রুপালী নদীর স্রোত

আমার ট্রেক সঙ্গীরা এসে যাওয়ার পর থেকেই মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল। যদিও ওদের অনেক অনেক কষ্ট হয়েছে সেটা বোঝা গেল। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক এমন দুর্গম পাহাড়ি পথে, বাঁকে বাঁকে ঝুঁকি আর যে কোন সময় যে কোন দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার মত পাহাড়ি ট্রেইলে এই ষাটোর্ধ দুই বন্ধু যে সাহস করে গোমুখ যাবার জন্য এসেছে সেটাই তো অনেক অনেক বড় একটা ব্যাপার।

ওদের সাহস আর মানসিকতার কাছে নিজেকে বেশ ছোটই মনে হল, কারন আমার তো ওদের প্রায় অর্ধেক বয়স তাতেই কত কষ্ট না হয়েছে। সেই তুলনায় ওরা তো অনেক অনেক ফিট আছে। এই বয়সে এলে আমাদের কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? সেই ভাবনায় পরে গেলাম।

তবে সে সন্ধ্যায় ওদের সাথে চায়ের আসর বসিয়ে সোনালি সন্ধ্যার অপেক্ষা করে করেও আর তাকে পাওয়া গেলনা। ঘন কুয়াসা আর ধূসর মেঘের আস্তরণে কাছে দূরের সব পাহাড় হারিয়ে গিয়েছে বলে। তাই সবাই যে যার রুমে উষ্ণতার জন্য ঢুকে গিয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য। তবে একটু পরে জেনারেটরের আলোয় নিয়ন লাইট জ্বলে ওঠার পরেই আবার বেরিয়ে পরেছিলাম মোবাইলে যদি কিছুটা পারা যায় চার্জ দিতে। লজের অফিস রুমে চার্জের ব্যবস্থা আছে দেখে রেখেছিলাম আর আমার অকেজ পাওয়ার ব্যাংক যথা সময়ে কাজ না করার আনন্দে!

তবে সন্ধ্যার এই বেরনোটা যে এতটা আনন্দের আর প্রাপ্তির হবে সেটা ভাবতেই পারিনি। প্রথমত বেরিয়েই দেখি লজের বিদেশী ট্রেকাররা সবাই বাইরে বেরিয়ে আকাশের চাঁদ-তারা নিয়ে দারুণ ব্যাস্ত আর উচ্ছ্বসিত সময় কাটাচ্ছে। আমি মোবাইলটা চার্জে দিয়ে এসেই ওদের উচ্ছ্বাসের কারন খুঁজতে চেষ্টা করলাম।

বেরিয়েই দেখি চারপাশের অন্ধকার উধাও হয়েছে গেছে, অর্ধ চাঁদের ঝকঝকে জ্যোৎস্নায়। সন্ধ্যার ভারি মেঘ কেটে গেছে কখন যেন, কুয়াসার চাদর সরে গেছে পাহাড়ের গা থেকে। সেইসব পাহাড়ে, পাহাড়ে, সাদা পাহাড়ের বরফে বরফে চাঁদের আলো পরে চারদিক রুপালী আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। দূরের আকাশে লক্ষ্য কোটি তারাদের জোনাকির মত জ্বলে থাকা দেখে বিমোহিত সবাই।

সেই সময়ই আরও দুই একজনের সাথে পরিচিত হলাম। আমি একা একা বাংলাদেশ থেকে শুধু গোমুখ ট্রেক করতে এসেছি যেনে কেউ কেউ দারুণ কৌতূহলী হয়ে উঠলো, ভাব জমালো ওর ভাঙা ভাঙা ইংরেজি দিয়েই। দুই একজন আমাকে বিব্রত করে দিয়ে নিজের সাথে আমাকে সেলফি বন্দী করতে চাইলে আমি বিব্রত হলেও না করতে পারলাম না। কেউ কেউ দেখলাম সেই রুপালী জ্যোৎস্নার মাঝে ক্ষীণ চোখে পরা পাহাড়ি গুল্ম, ঘাস, লতাপাতার মাঝ দিয়েই গঙ্গার তীরের দিকে যেতে চাইলো এবং আরও দুই একজন সঙ্গী পেয়ে পথ চলতে শুরু করলো। এমন সুযোগ আসবে চিন্তাই করিনি।

কারন এই রাতে, এমন নির্জন পাহাড়ি পথে, প্রায় জনমানবহীন ভৌতিক পরিবেশে একা একা কিছুতেই আমি গঙ্গার তীরে যেতে চাইতাম না ইচ্ছা থাকলেও। যে কারনে ওদের কয়েকজন সেই পথে পা বাড়াতেই আমার মাথায় খেলে গেল, শুধুমাত্র চাঁদের আলোয় আর মিটিমিটি তারার ঝিলিকে গঙ্গাকে, গঙ্গার উচ্ছ্বসিত জলধারাকে দেখতে কেমন লাগবে সেটা দেখতে পারার দুর্লভ সুযোগ পেয়েই লুফে নিতে পিছু পিছু পথে নেমে পরলাম।

কোথাও না থেমে শুধু গঙ্গার পারে যেতে মাত্র তিন থেকে চার মিনিট সময় লাগলো। সেখানে গিয়েই আমি শুধু নয়, যে কজন এসেছিল প্রায় প্রত্যেকেই খুশিতে উদ্ভাসিত। যেন চাঁদের আলোর চেয়েও বেশী আলোকিত ছিল সবার আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের মাত্রা।

নিজ নিয়মে, দুর্দান্ত বেগে ছুটে চলা রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে গঙ্গার তীরে সে রাতের রূপ ছিল অবর্ণনীয়। দূর থেকে ওপারের পাহাড়ের কালো দেয়ালে কোন চাঁদের আলো ছিলোনা। চাঁদ ঠিক সেই পাহাড়ের দেয়ালের উপরেই অবস্থিত ছিল বলে, যে কারনে প্রাথমিকভাবে নদীর জ্বলে চাঁদের কোন আলো প্রতিফলিত হয়নি।

কালো একটা পথে কান ফাটানো নদীর সঙ্গীতের মত করে ছুটে চলা নদীর শব্দ শুধু শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু নদীর একদম তীরে গিয়েই সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। পাহাড়ের দেয়ালের কালো ছায়ার পরে নদীর অন্য অংশে রুপালী চাঁদের ঝকঝকে জ্যোৎস্নার আলো পড়ে পুরো নদী যেন এক রুপালী স্রোতধারা হয়ে উঠেছিল।

পাথরে পাথরে পানির ছুটে জলায় বাঁধা পেয়ে ঢেউয়ের কিছু কিছু জলের কনা ছিটকে উপরে ওঠার সময় চাঁদের আলো পড়ে মনে হচ্ছিল যেন জ্বলজ্বলে মুক্ত দানা যেন নদী থেকে তীরে উঠে আসতে চাইছে! আর দূরে পাহাড়ের যে পথ পেরিয়ে পেরিয়ে আসছিল স্রোত সেই স্রোতকে মনে হল যেন রুপালী কোন স্রোত, চিকচিক করে ছুটে আসছে এদিকে।

আর যে পথে ছুটে চলছিল রুপালী জলের সম্মোহনী ধারা, যে ধারা কিছুদূর গিয়ে কিছুটা সমতলে পরে জলের ধারা থেমে গেছে, সেই পথ যেন কোন রুপোর কোন খনি! যা চাঁদ আর তারাদের ঝকঝকে আলোতে নদীর প্রায় থেমে থাকা জলকে আলোকিত আর চমকিত করে তুলছিল। নদীর জল যেন দূরে গিয়ে একটু থেমে চাঁদ আর তারাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল কৃতজ্ঞ হয়ে।

চাঁদ তার ঝলমলে জ্যোৎস্না, তারা তাদের ঝিকিমিকি আলো, কোন ছুটে যাওয়া উচ্ছ্বসিত নদীর এমন রুপালী রূপ এর আগে আমাদের সেই কজনের কেউই কোনদিন দেখিনি। যে কারনে কেউই কোন কথা না বলে চুপ করেছিলাম, ছিলাম বাঁকরুদ্ধ আর অপলক তাকিয়ে সেই রুপালী নদীর ছুটে যাওয় ঝলমলে জলের দিকে, পাথরে জ্বলে ধাক্কা লেগে ছিটকে ওঠা মুক্তোদানার উপরে, প্রায় থেমে থাকা নদীর রুপোর খনির দিকে। এমন অপূর্ব আর অসম্ভব নদীর রূপ, এমন সম্মোহনী জ্যোৎস্না আর এমন আকুল করে তোলা তারাদের দেখে দেখে অভিভূত আমরা সবাই।

ইচ্ছা হচ্ছিল অনন্ত সময় সেখানে ঠায় বসে থাকি। কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে সেটা আর সম্ভব না হওয়াতে সবাইকেই উঠতে হয়েছিল আবারো মেঘ আর কুয়াসারা পাহাড়, নদী, চাঁদ, তারাসহ আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরায়। নইলে হয়তো সুখের অসুখে জমে হিম হয়ে যেতাম। বেশী সুখ যে কারো জন্যই বেশী ভালো নয়।

ওতে করে সুখের অসুখে পরে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে যে কেউ। তাই সুখের অসুখে না পরে, অল্প কিন্তু সত্যি সত্যি এক অপার্থিব সুখের রেশটুকু সাথে করে নিয়ে যার যার আবাসে ফিরে ছিলাম একবুক সুখের জ্যোৎস্না, তারাদের মিটিমিটি আলো আর রুপালী নদীর অপূর্ব সুখ রূপের স্রোতে ভেসে গিয়ে।

Share:

Leave a Comment