লিডার নদীর প্রেমে

আমি প্রেমে পড়েছি! আমি আবারো প্রেমে পড়েছি! আমি বার বার প্রেমে পড়েছি! আমি এই মাত্র, এই গভীর রাতে, একাকী আধো শোয়া হয়ে তার প্রেমে পড়েছি। তার ছবি দেখতে দেখতে নতুন করে তার প্রেমে পড়লাম। অথচ তাকে আমি আগেই দেখেছি, খুব কাছ থেকে একদম বাস্তবে দেখেছি, তার পাশে বসেছি, হেঁটেছি, তাকে ছুঁয়েছি, তাকে ভালো লেগেছে, তাকে আমি ভালোও বেসেছি অনেকটাই। তবে এটা তো জানতাম যে ভালো লাগা, ভালোবাসা আর প্রেমে পড়া কখনোই এক নয়, হয় না, হতে পারে না।

কিন্তু আজকে সত্যি সত্যি ভালো লাগা আর ভালোবাসাকে পিছনে ফেলে আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম। আজকের আগে তার প্রেমে আমি পড়িনি সত্যি। সত্যি বলছি, আজ, এই গভীর রাতে তার ছবি দেখে, তার স্মৃতি, তার সাথে কাটানো অনেক অনেক সময়ের সেই ক্ষণ আর মুহূর্তগুলো মনে পড়ে আমি গভীরভাবে তার প্রেমে পড়েছি।

নাহ, যদিও সে কোনো মানবী নয়, নয় রক্তেমাংসে গড়া কোনো অপরূপ রূপসী। তবুও আমার কাছে সে যে কোনো মানবীর চেয়েও অনেক অনেক বেশী আকর্ষণীয়া, আক্ষেপের আর প্রার্থিত সব সময়। যে কোনো রক্তেমাংসে গড়া রূপসীর চেয়ে সে আমাকে তার কাছে অনেক অনেক বেশী করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাঁধনে জড়াচ্ছে, মায়ায় বেঁধে ফেলছে।

কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, এই সময়ে যে তার কাছে কিছুতেই যাওয়ার কোনো উপায় আমার হাতে নেই। সাধ আর সাধ্য হয়তো কোনোরকমে মেলাতে পারবো। কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতি, সামাজিকতা আর নির্মম বাস্তবতার কাছে আমার অবাধ্য প্রেম পরাজিত হয়ে যাচ্ছে আপাতত। আমি এতটাই নিরুপায় এই মুহূর্তে। এতটাই অসহায় আর নিদারুণ অবর্ণনীয় এক অব্যক্ত কষ্টের মাঝে পড়ে গেছি।

অবাধ্য, অপার্থিব আর পাগুলে প্রেমগুলো বোধহয় এমনই হয়। চুম্বকের মতো টানে, আকর্ষণে আকর্ষণে বিধ্বস্ত করে ফেলে, পুরনো স্মৃতিগুলো যেন আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, ছবিগুলো যেন অস্থির আর অবাধ্য করে তোলে। তাকে দেখার আকুলতায়, ছুঁয়ে দেবার বাসনায়, উন্মাদ আর উত্তাল করে তোলে এক ছুটে তার কাছে পালিয়ে যাওয়ার নেশায়। তার পাশে চুপ করে বসে থেকে অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকার সাধনায়।

তবুও তাকে ছোঁয়া যায় না, পাশে পাওয়া যায় না, দু’চোখ ভরে দেখা যায় না, তার আলতো আদরে উন্মাদ হওয়া যায় না, সে যে অনেক অনেক আর অনেক দূরে। আর আমিও যে তার থেকে অনেক অনেক আর অনেক দূরে। শত শত নয়, সহস্র মাইল দূরে দুজনের অবস্থান। তবুও কেন আর কীভাবে সে যেন আমাকে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য করে তুলেছে।

তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়, শ্রীনগর থেকে পাগল করা পেহেলগামে যেতে। পেহেলগামে ঢোকার বেশ আগে আগে, পথ যখন প্রায় সমতল ছিল। গাড়ি হু হু করে ছুটে চলছিল পেহেলগামের দিকে। দূর থেকে চোখে পড়লো সবুজ পাহাড়ের সারি সারি সিঁড়ি। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘেদের ওড়াউড়ি, কোথাও সাদা মেঘেদের দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো পাহাড়ের খোলা বারান্দায়। সেদিকেই ছিল দুই চোখ। হঠাৎ পথ চলার মাঝেই ঝমঝম শব্দের একটা সুর ভেসে এসে কানে লাগতে লাগলো।

মুহূর্তেই পাহাড় থেকে, পাহাড়ের গায়ে লেপটে থাকা সাদা মেঘেদের দল থেকে কানের সাথে চোখের সংযোগ হয়ে পাহাড়ের পায়ের কাছে ছুটে চলা এক অজানা নদীর অপরূপ রূপ আর তার অনন্ত যৌবনা কণ্ঠের মূর্ছনা ভেসে আসতে লাগলো। কিছুক্ষণ শুধু অপলক তাকিয়ে থাকা আর তাকিয়ে থাকা। কানে শুধু রিমঝিম, ঝমঝম আর নানা রকম সঙ্গীতের সুর এসে বাজতে লাগলো, সময়ের সাথে সাথে সুর বদল করে। সম্মোহিত হতে আর কিছুর প্রয়োজন ছিল না সেই মুহূর্তে।

ড্রাইভার জানালো লিডার নদীর শুরু হলো। ওই যে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে তার সুর বিলীন করে ছুটে চলেছে যে জলস্রোত সেটাই লিডার। পেহেলগামের স্বাগত উপহার। পেহেলগামের বিস্ময়, পেহেলগামের প্রেম আর পেহেলগামের অপার্থিব রূপের উৎস। আর একদম পেহেলগাম পৌঁছে, অসহ্য সুখের আরু ভ্যালীতে গিয়ে তাকে দেখে, বেতাব ভ্যালীর সমতলে লিডারের রূপ দেখে দেখেই আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, এই লিডার, এই লিডার নদীই পেহেলগামকে পাগল করা পেহেলগাম বানিয়েছে। এই লিডারের জন্যই অন্য কার কাছে কি জানি না, তবে আমার কাছে পাগল করা পেহেলগাম, শুধু এই লিডারের জন্যই।

কারণ এমন পাহাড়, পাহাড়ের নানা রকম রূপ, ভিন্নতা, পাহাড়ে পাহাড়ে মেঘেদের দল বেঁধে ছুটে চলা, সবুজ পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে রুক্ষ পাহাড়ের চড়া, রুক্ষ পাহাড়ের কঠিন সিঁড়ি বেয়ে বরফে মোড়ানো চূড়ায় পৌঁছে যাওয়া অনেক জায়গাতেই আছে, দেখা যায়, পাওয়া যায়।

কিন্তু শুধু এক পেহেলগামেই এই লিডার নদীর ক্ষণে ক্ষণে, বাঁকে বাঁকে, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে, একটু আগে পরে তার রূপের যে বদল, তার সুরের যে পরিবর্তন, তার হাসির যে ঝংকার, তার অপার্থিব যে আকর্ষণ, তার যে পাগল করা সম্মোহন সে আর কোথাও পাওয়া যাবে না, যায় না, আমি অন্তত দেখিনি কোথাও আর কোনোদিন দেখা যাবে কিনা সেও আমার ভীষণ সন্দেহের।

কোথাও লিডার পাহাড় আর সমতলের মাঝে ক্ষীণ সুর বিলিয়ে বয়ে চলেছে তার রূপের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে, কোথাও লিডার দুই পাহাড়ের মাঝে বয়ে চলেছে ঝংকার তুলে, কোথাও লিডার পাথরে পাথরে সুর তুলেছে চিৎকার করে, কোথাও লিডার, মিহি লয় তুলেছে ভিন্ন কোনো বাঁকে, কোথাও লিডার পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে এসেছে ঝমঝম করে, কোথাও লিডার ঝর্ণা হয়ে নেমে এসেছে গুনগুনিয়ে আর কোথাও লিডার সুখের, কোথাও লিডার সুর তুলে চলে গেছে বেদনার।

এক এক জায়গায় লিডার এক এক রূপে ধরা দিয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সুর তুলেছে, নানা রকম ছবি এঁকেছে, ভিন্ন কত রঙ ছড়িয়েছে, কতভাবে ভালোবেসেছে, কীভাবে কীভাবে কাছে এসেছে আবার অবাক করে দূরে চলে গিয়ে হুট করেই কাছে এসে ছুঁয়ে দিয়েছে। আজ এই নিশুতি রাতে তার সাথে কাটানো নানা রঙের, ঢঙের, সুরের আর মূর্ছনা ছড়ানো দিন, ক্ষণ আর মুহূর্তগুলোকে ভীষণভাবে মনে পড়ছে, স্মৃতিরা জানালায় তার জন্য হাহাকার তুলেছে, ছবিগুলো আমাকে পুড়িয়ে মারছে, তার কাছে পালিয়ে যেতে না পারার আক্ষেপ আমাকে যেন কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে।

তার মানে তো তাই-ই। আমি তার প্রেমে পড়েছি। তাকে প্রথমে ভালো লেগেছিল খুব। কাছ থেকে দেখে, বসে, হেঁটে, সময় কাটিয়ে আর তার স্পর্শ পেয়ে তাকে ভালোও বেসে ফেলেছিলাম সত্যি। তবে প্রেমে পড়ে যাইনি তার। কিন্তু আজ তার প্রেমেই পড়ে গেলাম। ছবি দেখে, স্মৃতি হাতড়ে, অবাক করে, অজান্তেই। এভাবেই বুঝি প্রেমে পড়া যায়, প্রেমে পড়া হয়, প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাওয়া যায়।

নদীর প্রেমে, পেহেলগামের প্রেমে, লিডারের প্রেমে।

Share:

Leave a Comment