শুভ্র পাহাড়ের দেশে

অনেকদিনের পরিকল্পনা অনেক সপ্ন বোনা শেষে আমরা ৪ জন ২৫ জানুয়ারী উড়াল দিলাম গল্পে শোনা দেশ কাশ্মির।
সকাল ৮.১৫ এর বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট অন টাইমে ছিল। দুপুর নাগাত চলে গেলাম কলকাতা।

দুপুরে কলকাতা নিউ মার্কেট এ টাকা রুপি করে খেতে গেলাম কস্তুরির বিখ্যাত চিংড়ি। বিকাল টা নিউ মার্কেট ঘুরে সন্ধ্যা নাগাত এয়ারপোর্টের পাশেই হোটেল বাবুল এ।

পরেরদিন সকাল ৭ টায় এয়ার ইন্ডিয়ায় উড়ে ১০ টায় দিল্লি। দিল্লি থেকে দুপুর ১.৩০ এ গো এয়ার এ বিকেল ৩ টায় শ্রীনগর এয়ারপোর্টে।

এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলেন জাবিদ ভাই। এই ট্যুর এ ওনার সহযোগিতা কথা বলে শেষ করা যাবে না। একজন ড্রাইভার ট্যুর গাইড কিভাবে বন্ধুর মত হয়ে যেতে পারে সেটা আগে বুঝিনি। এয়ারপোর্টে নেমেই বিশাল ধাক্কা খেলাম। তাপমাত্রা তখন শুন্য ডিগ্রি। ❄❄❄

বুকিং ডট কম থেকে বুক করা হোটেল রয়াল কম্ফোর্ট রিগেন্সিতে চলে গেলাম ডাল লেকের ১৪ নং ঘাটের কাছেই হোটেল। হোটেলে ব্যাগ রেখে জাবিদ ভাই এর গাড়িতে করেই চলে গেলাম মাটন বিরিয়ানি খেতে। এখন ও চোখ বন্ধ করলে সেই স্বাদ পাই। রেস্টুরেন্টে বসেই ঠিক করে ফেললাম আগামীকাল আমরা যাচ্ছি সোন্মার্গ।

ভাগ্য এতই ভালো খেতে খেতেই স্নোফল শুরু হয়ে গেল। জীবনের প্রথম স্নোফল দর্শন। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা শুধু।

#সোন্মার্গ

জাবিদ ভাই আগেই বলে রেখেছিলেন আমরা সোন্মার্গ পর্যন্ত যেতে পারব না রাস্তা বন্ধ থাকার কারনে। আমরা যেতে পেরেছিলাম গগনগীর ( সোন্মার্গ থেকে ১৩ কিমি আগে) পর্যন্ত। প্রথমে মন খারাপ হলেও আমরা আস্তে আস্তে যখন শহর থেকে বের হলাম শুভ্র পাহার গুলো চলতে থাকল আমদের সাথে সাথে। এত সুন্দর যে মনে হচ্ছিল আমার চোখ মাত্র দুটি কেনো।

আগে থেকে জাবিদ ভাই বলে দিয়েছিলেন ঘোড়া না নেয়ার জন্য। আমরা গগনগীর নেমে পাশেই পার্ক এ ঢুকলাম। দুপুরে একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে শ্রীনগর এ চলে এলাম। যাওয়া আসার পথটাই এত সুন্দর যে আফসোস থাকল না। বিকেলে এসে অন্য একটি হোটেল গ্রান্ড এম এস এ উঠলাম যেখানের আথিতিয়তায় মুগ্ধ হয়ে আমরা পরের ৫ দিন এখানেই ছিলাম।

#গুল্মার্গ

পরেরদিন সকালে যথারিতি হোটেলের সামনে জাবিদ ভাই হাজির। জাবিদ ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন ট্যান্মার্গ পর্যন্ত। এখানে এটাই নিয়ম। ট্যান্মার্গ থেকে বরফে ঢাকা রাস্তা বিধায় ইউনিয়ন এর ঠিক করা চাকায় চেইনওয়ালা গাড়ি নিতেই হবে। ফিক্স রেট ১৬০০ রুপি। গুল্মার্গ নামার পরে গন্ডোলা কিভাবে যেতে হবে, কিভাবে স্লেজ ওয়ালা দের এড়িয়ে চলতে হবে তা জাবিদ ভাই একটা কাগজে ছবি একে সাথে দিয়ে দিয়েছিলেন। গুল্মার্গ নামার পরেই মিনিমাম ২০ জন ঘিরে ঘরল। আমরা হেটে গন্ডলা পর্যন্ত যাওয়া অবধি সাথে সাথে বিরক্ত করতেই থাকল। সেই সময়টা কিভাবে ধৈর্য রেখেছি নিজেই জানিনা। তাদের কোন কথা না শুনেই পার পারসন ৭৪০ রুপি দিয়ে ফার্স্ট ফেইস পর্যন্ত গন্ডলার টিকেট কেটে উঠে পরলাম কেবল কার এ। ট্যান্মার্গ থেকে বুট আর এক্সট্রা জ্যাকেট ভাড়া করে এনেছিলাম পার পারসন ২০০ রুপি করে। শুধু বুট নিলেই হত। কেবল কার থেকে নেমে বিভিন্ন স্নো একটিভিটি করা যায়। আমরা ১.৩০ ঘন্টা সময় কাটালাম সেখানে। পরে ফিরে এলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে সেখানে থেকে আমাদের গাড়ি করে ট্যান্মার্গ। শ্রীনগর যাওয়ার পথে খেলাম বিখ্যাত কাশিরি পোলাও আর রোগান জস। গেলে অবশ্যই খাবেন।

#পেহেল্গাম

হোটেলে সকাল সকাল নাস্তা সেরে বেরিয়ে পরলাম। যাওয়ার পথে পরল জাফরানেত খেত। সিজন না থাকায় ফাকা মাঠ দেখলাম। জাবিদ ভাই অবশ্য গাড়ি থামিয়ে আমাদের বিখ্যাত কাশিরি কাওয়া খাওয়ালেন নিজের টাকায়। জাফরানের খেতের মালিকের নিজের দোকান থেকে কিছু জাফরান কিনে নিলাম। অনন্তনাগ পার হতেই পরল আপেল বাগান। যতদুর চোখ যায় শুধু আপেল বাগান। সিজন না বিধায় ন্যাড়া গাছ দেখতে হল। পেহেল্গাম পোছানোর ঠিক আগেই লিডার নদির ব্রিজ এ ছবি তুলে নিলাম। পেহেল্গাম এ কিভাবে ঘোড়াওয়ালাদের সাথে দামাদামি করতে হবে তা জাবিদ ভাই বাতিয়ে দিলেন বিস্তারিত। ৪ জনে ৪ টা ঘোড়া নিয়ে নিলাম ৪ টা স্পট দেখার জন্য। ঘোড়াদের আলাদা আলদা নাম আছে, আমারটার নাম ছিল বাদশাহ 🎠🎠🎠
মিনি সুইজারল্যান্ড যখন পোছালাম তখন সেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম অন্য এক নিরব সুন্দরের মাঝে। সেখান থেকে ফিরে জাবিদ ভাই এর গারিতে করে গেলাম অরু ভ্যালি। শ্রীনগর ফেরার পথে খেলাম কাবাব আর রুটি।

#দুধপাত্রী

পরেরদিন সকালে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখি স্নোফল। আমরা রহনা দিলাম দুধপাত্রি। অধিক বরফের কারনে ৮ কিমি আগেই আমরা থামতে বাধ্য হলাম। গাড়ি থেকে নেমে ছবি তুলে ঝটপট গাড়িতে উঠে গেলাম। কারন তাপমাত্রা তখন -৮ ডিগ্রি। দুপুরেই চলে এলাম শ্রীনগর, মুঘল দরবারে লাঞ্চ সেরে চলে গেলাম লালচক। বিকাল্টা কেটে গেল শপিং এ।

#শ্রীনগর

কাস্মিরে আমাদের শেষ দিন, এই দিন আবার আমার জন্মদিন। সকালে উঠে জানালার পর্দা সরাতেই দেখি আকাশ থেকে তুলা খসে পরার মত তুশারপাত হচ্ছে। এইদিন আমরা শিকারাতে ঘুরলাম ডাল লেক এ। মুঘলদের বাগান নিশাতবাগ, শালিমারবাগ এ গেলাম। নরেন্দ্র মোদি কাশ্মিরে আসবে বিধায় চশ্মেশাহী বন্ধ ছিল। হযরত বাল মসজিদ দেখে এর সাম্নের রুটি হালুয়া খেতে ভুল্লাম না। শহর ঘুরতে ঘুরতে শুনলাম জাবিদ ভাই এর জিবনের কাহিনি। কিভাবে তিনি পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলেন সেই ১৯৯২ সালে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরেও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে কিভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন।

#ফেরার_পথে_বিপদ

আমাদের শ্রীনগর থেকে এয়ার এসিয়ার ফ্লাইট ছিল সকাল ৯.৩০ এ। কিন্তু ব্যাড ওয়েদারের কারনে সকাল থেকে কোন ফ্লাইট আসেওনি, যায়ওনি। টেনশন শুরু হয়ে গেল আমার। দুপুর দুইটায় দিল্লি থেকে কলকাতা ফ্লাইট টা মিস হয়ে গেলো। আমরা শ্রীনগর থেকে ফ্লাই করলাম দুপুর ১.৩০ এ দিল্লি পৌছালাম ৩ টায়। নেমেই মেক মাই ট্রিপ থেকে ভিস্তারার বিকেল ৫.৩০ এর টিকিট কাটলাম কলকাতার। পরেরদিন দুপুর বাংলাদেশ বিমানের সকাল ১১ টায় বাংলাদেশ পৌছালা।

কিছু শিক্ষা-
১. শীতকালে হিলি এরিয়ার সকালের ফ্লাইট নিতে নেই।
২. কাশ্মিরে সব কিছুতেই দামাদামি করুন। ১০০০ বললে আপনি ২০০ বলুন।
৩. সেইম এয়ারলাইনস এর কানেক্টিং ফ্লাইট নিন তাতে যেকোন এক্টার জন্য অন্যটা মিস হলেও ওরাই ম্যানেজ করে দিবে।
৪. শীতকালে কাশ্নির গেলে অবশ্যই হোটেল এ ডিনার ইনক্লুডেড নিয়ে নিবেন। এত ঠান্ডা যে খেতে যেতেই কষ্ট হয়ে যাবে।
৫. বিয়ের আগে কাশ্নির গেলে দেশে এসে মেয়ে পছন্দ না হলে আমি দায়ী না।

পুরো ট্যুর আমি চেষ্টা করেছি ডাস্টবিন ছাড়া ময়ালা না ফেলার। প্লিজ প্লিজ প্লিজ ভ্রমনে গেলে পরিছন্নতা বজায় রাখুন।

Share:

Leave a Comment