নো ম্যান্স ল্যান্ড কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ভাঙা গড়া

কিন্তু না পরের শনিবার আর কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই ভিসা পেয়েছিল অরণ্য। ভিসা পেয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিল খুশিতে, আনন্দে, উচ্ছ্বাসে যেটা হয় আর কী! কখনো কখনো অনেক কাঙ্ক্ষিত, স্বপ্নের আর কল্পনার কিছু পেয়ে গেলে এমন হয়! সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায় কয়েক মুহূর্তের জন্য! অরণ্যরও তেমন হয়েছিল। চুপচাপ লেকের পাশে বসেছিল বেশ কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবছিল কতদিন ধরে কত শত চেষ্টা করে আজ ভিসা পেল সে, অধরার সাথে দেখা করতে যাবে বলে। সেই দিন তবে এসেই গেল, অরণ্য আর অধরার জীবনে। এবার ওরা ভাঙবে “নো ম্যান্স ল্যান্ড” এর বাধা!

বেশ কিছুক্ষণ এম্বাসির পাশে অবস্থিত লেকের পাশে বসে থেকে, যখন চেতনা ফিরে পেয়েছিল তখন কানে হেডফোন লাগিয়ে প্রিয় গানের সুর ছড়িয়ে দিচ্ছিল উচ্চস্বরে, সাথে গলাও মেলাচ্ছিল গুনগুন করে। এরপর হেঁটে হেঁটে বাসে উঠেছিল। বাসে উঠতেই বাইরে শুরু হলো ঝড়ো হাওয়া! কালো মেঘের আনাগোনা, টিপটিপ বৃষ্টি। সবকিছুই যেন সৃষ্টিকর্তার হাতে ধরে সাজিয়ে দেয়া। যেন ঝড়ো হাওয়া নয়, অধরার উচ্ছ্বাস! যেন কালো মেঘ আকাশের ঢেকে যাওয়া নয়, অরণ্যকে অধরার জড়িয়ে রাখা! যেন টিপটিপ বৃষ্টি নয়, অধরার সুখের অশ্রু! যেন বিদ্যুৎ চমক নয়, অধরার আনন্দের উচ্ছ্বাস! ঠিক এমনই মনে হচ্ছিল অরণ্যর!

বাইরে বৃষ্টির বেগ বাড়লো, অরণ্যর বাড়লো আনন্দের শিহরণ! ধীরে ধীরে জানালার কাঁচ খুলে বাইরে হাত দিল অরণ্য, একটু ছুঁয়ে দেখবে অধরাকে! বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখাই হবে অধরাকে ছুঁয়ে দেখার মতো অনন্য অনুভূতি! তাই অরণ্য ছুঁয়ে দিল, ঝরে পড়া বৃষ্টিময় অধরাকে। আর বৃষ্টিতে হাত ভেজাতেই কল্পনায় ভেসে গেল ওদের অনেক দিনের লালিত স্বপ্নের ঠিকানায়। জলপাইগুড়ির চা বাগানের সবুজ সমুদ্রে! যেখানে তুমুল বৃষ্টির সাথে ঝড়ো হাওয়া মিলেমিশে তৈরি করেছে এক অদ্ভুত সুখের ঢেউ! পুরো চা বাগানজুড়ে যেন অজানা আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে বৃষ্টি-বাতাস আর সবুজে ছেঁয়ে থাকা দিগন্তজুড়ে!

জানালার বাইরে বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়ে অরণ্য চোখ বন্ধ করে ফেলল অজান্তেই, আর দেখতে পেল চা বাগানের সেই তুমুল ঝড় বৃষ্টির মাঝে একটি হলুদ ছাতার নিচে অরণ্য আর অধরা একসাথে, রেখে হাতে হাত, মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ! অধরার কমলা রঙের স্কার্টের উপরে চাপিয়েছে একটি নীল রঙের জামা, মাথায় সাতরঙা হ্যাট, কপালে একটি ছোট্ট কালো টিপ, গলায় একটি টকটকে লাল মুক্তোর মালা, দুহাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, খোপায় সদ্য ফুটে ওঠা আর মাদকতাময় ঘ্রাণ ছড়ানো কদম ফুল, আর ধবধবে খালি পায়ে পরেছে সুর তোলা নূপুর! যদিও বৃষ্টির গানের কাছে নূপুরের ঝংকার তখন শব্দহীন। তবুও ভালো লাগছিল দেখতে… আর এমন করে ভেসে যেতে কল্পনার রঙিন জগতে, চা বাগানের সবুজ সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত ঢেউয়ে!

ও ভাই নামবেন না…? উহ, বাস কন্টাকটারের কর্কশ কণ্ঠ!

ঘুমের জগতে গিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখছিল অরণ্য!

জি ভাই নামবো।

কিন্তু কীভাবে নামবে? যে বৃষ্টি বাইরে! তবুও নামতেই হলো, কোনো উপায় নেই যে। বৃষ্টিতে নেমে, পকেট গেঞ্জি দিয়ে কোনোমতে ঢেকে রেখে, ছুট দিল অরণ্য কোনো দোকানের টিনের তলায়, পাছে পাসপোর্ট আর এত সাধের ভিসা ভিজে গিয়ে অকার্যকর হয়ে যায় আবার!

বৃষ্টি একটু ধরতেই রিক্সা নিল অরণ্য, বাসায় যাবে। বাসায় গিয়েই অধরার সাথে শুরু হলো কথোপকথন। দুজনে মিলে প্ল্যান করলো, অরণ্য অফিস থেকে ছুটি নেবে দুইদিন, রবি আর সোম, সাথে থাকবে শুক্র আর শনি, অরণ্য ঢাকা থেকে বাসে উঠবে বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে। ব্যাকগ্রাউন্ডে যেন বেজে উঠলো এই গান- “আহা কী আনন্দ, মেঘেতে-বৃষ্টিতে! (আকাশে-বাতাসে)”

দারুণ আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে পরদিন অফিসে গেল অরণ্য। অরণ্যর ফেসবুক স্ট্যাটাস ভেসে যেতে লাগলো বন্ধুদের রেসপন্স আর উৎসাহে, কারণ ওরা সবাই জানে সেই তেতুলিয়ায় “নো ম্যান্স ল্যান্ডের” চা বাগানে অরণ্যর সাথে অধরার দেখা হওয়ার পর থেকে সবাই মিলে কত কাঠখড়ই না পুড়িয়েছে একবার ভিসা পাবার জন্য! সইতে হয়েছে কত শত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর দুর্ভোগ। তাই সবাই উচ্ছ্বসিত অরণ্য আর অধরার জন্য। দেখার ও শোনার অপেক্ষায় ওদের পরের গল্পর।

অরণ্য পাসপোর্ট-ভিসার ফটোকপি করলো। ছবি ঠিক করলো, ব্যাগ গোছাতে শুরু করল, বাংলাবান্ধা পোর্ট এর খোঁজ খবর নিল, বাসের টিকেটের খোঁজ নিল। এখানে এসেই আটকে গেল! কারণ বাংলাবান্ধা বা তেতুলিয়া পর্যন্ত বাস যাচ্ছে না, বাস যাচ্ছে দিনাজপুর পর্যন্ত, ওদিকে কোনো ঝামেলা হয়েছে তাই আপাতত বন্ধ আছে। এক সপ্তাহ পরে বাস চলবে বলে জানা গেল। বেশ কষ্ট পেল অরণ্য আর অধরাও, তাই সেই সপ্তাহে না গিয়ে পিছিয়ে দিল এক সপ্তাহ।

ঠিক এক সপ্তাহ পরে আবার জলপাইগুড়ি যাবার তোড়জোড় শুরু করলো অরণ্য। ওপারে অপেক্ষায় অধরা। দাঁড়িয়ে “নো ম্যান্স ল্যান্ডে”, একই চা বাগান অথচ মাঝখানে কাঁটাতার! এ যেন সীমান্তে নয়, হৃদয়ে কাঁটাতার। তবে সান্ত্বনা এই যে আর যাই হোক বাধা তো নেই অন্তত ভিসার, ডিঙাতে তো হবে না ভিসার কোনো পাহাড়!

অফিসে গেল অরণ্য। সবকিছু ঠিকঠাক। ছুটির আবেদন করলো দুইদিনের, সাথে NOC এর (No Objection Certificate)। চাকুরীরত প্রার্থীর দেশের বাইরে যেতে সেটা আবশ্যক। বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী সহ নানা পরিচিত জনেরা অপেক্ষায় অরণ্য আর অধরার দেখা হবার।

কিন্তু আবারো ভেঙে গেল ওদের স্বপ্ন! যেতে পারলো না অরণ্য! সেই সপ্তাহেও! কারণ, অফিস থেকে ছুটি পায়নি অরণ্য, ঈদের ঠিক আগে আগে ছুটি দেবে না অফিস বা অফিসের বস! তাই এ যাত্রাও যেতে পারলো না! ভেঙে গেল নতুন করে গড়ে তোলা স্বপ্ন, ছিঁড়ে গেল কল্পনায় বোনা রঙিন জাল, ধূসর হলো বর্ণিল ভাবনাগুলোও!

তবে কি সেই ঈদের ছুটির অপেক্ষায় থাকতে হবে? তখনও কি যেতে পারবে অরণ্য, পেরিয়ে পরিবারিক বাধা? কতদিন চলবে অরণ্য আর অধরার স্বপ্নের এই ভাঙা-গড়ার খেলা?

Share:

Leave a Comment