ভাটিয়ারীর পথে প্রান্তরে সকাল-সন্ধ্যা
দেশের সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো খুব সাজানো গোছানো ও পরিপাটি হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ সেনানিবাসেই নিরাপত্তার খাতিরে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ থাকে। তবে এদিক থেকে একদম ভিন্ন হলো ভাটিয়ারী ইউনিয়ন।
মূল সেনানিবাসে সাধারণ মানুষ ঢুকতে না পারলেও এর আশেপাশের অনেক সুন্দর স্থান সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তাই একদিনের ট্যুর প্ল্যানের জন্য ভাটিয়ারী একদম আদর্শ স্থান। গত সপ্তাহেই দলবল নিয়ে হানা দিয়েছিলাম চট্টগ্রামের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট এই ভাটিয়ারীতে। আজ থাকছে ভাটিয়ারী ভ্রমণের আদ্যোপান্ত।
ভাটিয়ারী ইউনিয়ন:
চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ১৫ কি.মি. দূরত্বে সীতাকুণ্ড উপজেলার দক্ষিণাংশে ভাটিয়ারী ইউনিয়ন অবস্থিত। সবুজ পাহাড়, স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ লেকের পানি, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত গলফ কোর্স, সানসেট পয়েন্ট- এসব কিছু মিলিয়ে অসাধারণ প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যে ভরপুর ভাটিয়ারী। সম্পূর্ণ অঞ্চলটি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব উন্নত। তাই যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা একদমই কম।
যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে যেতে হলে রাতের বাসে কিংবা ট্রেনে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। এতে সকাল সকাল ভাটিয়ারী পৌঁছে সারাদিন সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ইউনিক, শ্যামলী, সৌদিয়া, এস এ পরিবহনসহ আরও অনেক বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৪৮০ টাকা। সুপারভাইজারকে বলে রাখবেন যেন ভাটিয়ারী নামিয়ে দেয়।
চট্টগ্রাম শহর থেকে সরাসরি ভাটিয়ারী সিএনজি অটোরিক্সা ভাড়া করে যাওয়া যায়। ভাড়া দেড়শো থেকে দুইশো টাকা। অথবা চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড় থেকে ৪ নম্বর বাসে করে ভাটিয়ারী যেতে পারেন। লোকাল বাস বিধায় বাসে খানিকটা অস্বস্তি লাগতে পারে। তবে অভ্যাস থাকলে একদমই সমস্যা নেই।
চট্টগ্রামের হাটহাজারি কিংবা ওই দিকের ভ্রমণপিপাসু মানুষদের জন্য বড় দিঘীর পাড় হয়ে ভাটিয়ারী আসাটা সুবিধাজনক। বড় দিঘীর পাড় থেকে লোকাল সিএনজি ও বড় পিকাপের মতো যাত্রীবাহী গাড়ি পাওয়া যায়। সিএনজিতে ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা। পিকাপে ২০ টাকা।
চাইলে সিএনজি রিজার্ভ নিয়ে নিতে পারেন। তবে আমার মনে হয় রিজার্ভ না নিয়ে লোকালভাবে চলাচল করাই ভালো। এতে টাকাও খরচ কম হবে, সাথে সব স্পট নিজের ইচ্ছামতো সময় নিয়ে দেখতে পারবেন।
যা যা দেখবেন:
পাহাড়ী আঁকাবাঁকা ও উঁচুনিচু ভাটিয়ারীর সুসজ্জিত রাস্তাটা আপনার মনেপ্রাণে ভীষণ সুখকর অনুভূতি জাগাবে। রাস্তার পাশেই স্বচ্ছ পানির ভাটিয়ারী লেক। লেকে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। তবে লেকের চারপাশে সবুজের অভয়ারণ্য সত্যিই খুব চমৎকার। প্রকৃতি দেবী যেন নিজ হাতে সুনিপুণভাবে সাজিয়েছেন এলাকাটি। এতটা সুন্দর চারদিক।
সিএনজি নিয়ে প্রথমেই চলে যাবেন ক্যাফে টুয়েন্টি ফোর নামক পার্কে। সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই পার্কে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুস্থ পরিবেশে ঘুরতে পারবেন। প্রবেশমূল্য ৫০ টাকা। চট্টগ্রামের অন্যান্য পার্ক থেকে একদমই আলাদা এই পার্কে আছে কৃত্রিম ঝর্ণা, লেক, লেকে ঘোরার জন্য বিভিন্ন রাইড। এছাড়াও সবুজ প্রকৃতিতে বসে আড্ডা দেয়ার জন্য এই পার্কের তুলনা হয় না।
এডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য এখানে গাছের উপরে এডভেঞ্চার ট্রেইল তৈরি করা হয়েছে। মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে এই এডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে পারেন। এখানকার রেস্টুরেন্টও বেশ সুন্দর, চাইলে সেখানে দুপুরের খাবার খেতে পারেন। ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে দাম কিছুটা বেশি।
এরপর রয়েছে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম গলফ এন্ড কান্ট্রি ক্লাব। এটি চট্টগ্রামের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ স্থান যা প্রাকৃতিক লেক এবং পাহাড় দিয়ে আবৃত। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ভাটিয়ারী গলফ ক্লাবের গলফ কোর্সের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬,৫০০ গজ। গলফ কোর্সটির চারপাশের প্রকৃতি একে বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর কোর্সের মর্যাদা এনে দিয়েছে। এখানে সারা বছর ধরে নানা দেশী এবং আর্ন্তজাতিক গলফ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়।
গলফ ক্লাবে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তবে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন। প্রবেশ করতে পারলেও সেখানে ক্যামেরা এবং রেকর্ডিং ডিভাইস নিয়ে প্রবেশ করা যায় না। কারণ ছবি ও ভিডিও করা সম্পূর্ণ রূপে নিষেধ। এছাড়াও গলফ ক্লাবে গলফ গোল্ডেন নামক ভালো মানের একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
গলফ ক্লাব থেকে সোজা চলে যাবেন সানসেট পয়েন্টে। ব্যক্তিগতভাবে ভাটিয়ারীর এই জায়গাটিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। বিকেলের স্নিগ্ধ আলোতে পাহাড়, সমুদ্র এবং লেক সব মিলিয়ে এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি হয় এখানে। সানসেট পয়েন্টে বসার জন্য অনেক বেঞ্চ রাখা হয়েছে। এখানে বসে প্রকৃতিকে সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করতে পারবেন।
নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এখানে সবাই সূর্যাস্ত দেখতে আসে। দূরে সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্ত দেখার দৃশ্যটি সত্যিই অসাধারণ। সানসেট পয়েন্ট এলাকাটি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী (বিএমএ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এলাকা। এখান থেকে মিলিটারি একাডেমীর সম্পূর্ণ ভিউ দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যাস্ত দেখার সময় এখানকার ক্যান্টিনের কফি কিছুতেই মিস করবেন না।
সূর্যাস্ত দেখে দ্রুত রওনা দিন। কারণ নিরাপত্তাজনিত কারণে ভাটিয়ারী-হাটহাজারি কানেক্টিং রোডে সন্ধ্যা ৭টার পরে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। তাই সানসেট পয়েন্ট থেকে বের হয়ে সিএনজি নিয়ে দ্রুত চলে আসুন। নইলে পরে হেঁটেই রওনা দিতে হতে পারে।
পরিশেষে কিছু সতর্কবার্তা দিতে চাই। কোনো ধরনের পচনশীল ও অপচনশীল ময়লা আবর্জনা ভাটিয়ারী লেকে কিংবা আশেপাশের এলাকায় ফেলবেন না। এখানকার প্রায় সব জায়গাতেই প্রচুর সংখ্যক আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে। আর হ্যাঁ, বেশ শান্ত পরিবেশের এই এলাকাটিতে হই-হুল্লোড় থেকে একদম বিরত থাকুন। সর্বোপরি প্রকৃতিকে সম্মান করুন, ভালোবাসুন তার উদারতাকে। হ্যাপী ট্রাভেলিং।
source: http://neotravel.co/ভাটিয়ারীর-পথে-প্রান্তরে/