দিল্লী আগ্রা জয়পুর যোধপুর আজমীর পুষ্কার এবং কলকাতা ভ্রমণ
গত বছর নভেম্বরে আমি , আমার বাবা মা এবং আমার ছয় বছরের ছোট বোন ঘুরে এলাম ভারত এর এই কয়েকটি জায়গা । যাত্রা শুরু হয়েছিলো ৭ তারিখ , আমাদের ফ্লাইট ছিলো বিকাল ৪ টা ১০ এ । প্রথমে আমরা ঢাকা থেকে কলকাতায় যাই , কলকাতায় দেড় ঘন্টা ব্রেকে আরেকটি ট্রানজিট ফ্লাইটে
আমরা সেদিনই যাই দিল্লী । আমরা যেদিন যাই সেদিন ছিল দিওয়ালি , তাই দিল্লির সেদিনের আলোকসজ্জা দেখে রিতিমতো অবাক হয়ে যাই । দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে হতে ইন্ডিয়ান সময়ে রাত ৯ টা ৩০ । আমরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার আগেই দিল্লীর একটা ট্যুর এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে
যাই , তারাই দিল্লীতে আমাদের হোটেল আগে থেকে বুক করে দেয় এবং এয়ারপোর্ট শাটল এর ব্যবস্থা করে দেয় । হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১০ টা ৩০ । পৌঁছানোর পর ফ্রেশ হয়ে সেদিন রাতে হোটেলেই ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়ি ।
পরের দিন সকালে উঠে হোটেলেই নাস্তা করি , যা বুফে ব্রেকফাস্ট (কলকাতার হোটেল ছাড়া সবগুলো হোটেলেই ফ্রি বুফে ব্রেকফাস্ট ছিলো, যেখানে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট এবং ইন্ডিয়ান ট্রেডিশনাল ব্রেকফাস্ট ছিলো ) । নাস্তা করার পর ট্যুর এজেন্সির লোককে আমাদের সাথে দেখা করতে আসতে বলি
এবং সে এসে আমাদের একটি প্যাকেজ এর ব্যবস্থা করে দেয় । প্যাকেজ এর ভিত্তিতে আমরা পরবর্তীতে ঘোরাঘোরি করি ।
-নভেম্বর — সকালের ব্রেকফাস্ট সেড়ে ১০ টায় আমরা দিল্লী ঘুরে দেখতে বের হই । প্রথমেই আমরা দিল্লীতে অবস্থিত ইন্ডিয়ার বিখ্যাত রেড ফোর্ট ঘুরে দেখি । তারপর আমরা একে একে রাজঘাট , চাঁদনী চক মার্কেট , জুম্মা মসজিদ, ইন্ডিয়া গেট্ ,প্রেসিডেন্ট ভবন , হুমায়ুন এর সমাধি , পদ্ম মন্দির (লোটাস টেম্পেল) , লক্ষী নারায়ণ মন্দির
ঘুরে দেখি।দুপুরে আমরা পুরান দিল্লীতে খাবার খাই এবং সন্ধ্যা ৭ টায় হোটেলে ফিরে আসি । তবে মন্দির দুটোয় আমরা ঢুকি নি , কারণ দিওয়ালির জন্য সেদিন চেকিং এর অনেক লম্বা লাইন ছিলো । এছাড়াও প্রতিটি স্থানেই অতিরিক্ত ভিড় ছিলো দিওয়ালির কারণে । রাতে হোটেলের আসে পাশেই একটু ঘোরাঘোরি করি এবং কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে
রাতের খাবার খেয়ে , হোটেলে এসে ঘুমিয়ে পড়ি ।
নভেম্বর – সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আগ্রার উদ্দেশ্যে রওনা হই । আগ্রায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর ২.৩০ টা । যাত্রাবিরতি তে নাস্তা করায় সেদিন আমরা কেওই দুপুরে খেলাম না । হোটেলে চেক ইন করে, একটু ফ্রেশ হয়েই বের হয়ে পড়ি আগ্রা ফোর্ট দেখতে । আগ্রা ফোর্ট দেখার পর আগ্রার শহর একটূ ঘুরে দেখি , এবং লোকাল বিভিন্ন দোকান থেকে
হালকা কেনাকাটা করি । সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে সেদিন বেশ তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ি ।
-নভেম্বর – খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি ।নাস্তা শেষ করে হোটেল থেকে চেক আউট করে তাজমহল দেখতে যাই । তাজমহল দেখার অনুভূতি বলার মতো না । তাজমহল থেকে বের হয়ে বেলা ৯ টা ৩০ এ জয়পুর এর উদ্দেশ্যে রওনা দেই । জয়পুর যাওার পথে রাস্তায় ফাতেহপুর সিকরির জামে মসজিদ,
সেলিম চিসতির সমাধি , পাচ মহল এবং বিখ্যাত অন্যান্য জায়গা ঘুরে দেখি । জয়পুর পৌঁছাই বিকাল ৫ টা ৩০ এ । সেদিন হোটেলেই রেস্ট নিয়ে , রাতে হোটেলে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি ।
-নভেম্বর – সকালে নাস্তা খেয়ে জয়পুর দেখতে বের হই । ইন্ডিয়ার মধ্যে দেখা শহরগুলোর মধ্যে জয়পুরই আমরা কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে । জয়পুরে প্রথমে আম্বার ফোর্ট ঘুরে দেখি , তারপর একে একে নাহাগার ফোর্ট , জায়গ্রাহ ফোর্ট , জল মহল , হাওয়া মহল , সিটি পেলেস , জন্তর মন্তর,
গালতা টেম্পল , হল মিউজিয়াম , শিশ মহল এবং জয় মহল দেখে বিকালের দিক খাবার খাই । এরপর পড়ন্ত বিকেলে একটা ব্যাটারিচালিত ছাদখোলা অটো রিক্সা ভাড়া করে জয়পুর শহর এর ভেতরে ঘুরি এবং সন্ধায় হোটেলে ফিরে আসি । হোটলে ফ্রেশ হয়ে আবার বের হয়ে পড়ি , শপিং এর জন্য ।
জয়পুর জুয়েলারি এবং এন্টিক প্রোডাক্ট এর জন্য বিখ্যাত । কেনাকাটা শেষে রাতে হোটেলে ফিরে ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়ি ।
-নভেম্বর – ব্রেকফাস্ট শেষ করে যোধপুর এর উদ্দেশ্যে রওনা দেই । যোধপুরে হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ৬ টা । সেদিন আমরা আর কোথাও না গিয়ে হোটেলেই থাকি এবং হোটেলে রাতের খাবার খাই ।
-নভেম্বর – সকালের খাবার শেষ করে যোধপুর ঘুরে দেখতে বের হই । প্রথমেই যাই মেহরাংগ ফোর্ট যা ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় ফোর্ট গুলোর মধ্যে একটা । এই ফোর্ট দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি , এর কারুকার্য এবং বিশালতার জন্য । এছাড়াও এটি শহর থেকে প্রায় ৪০০ মিটার উপরে , একটি পাথুরে পাহাড়ের উপর অবস্থিত।
এরপর যোধপুর এর ক্লক টাওয়ার , স্পাইস মার্কেট এবং উমেদ ভবন মিউজিয়াম ভিজিট করি ( যা মূলত একটি রাজপ্রাসাদ এবং বর্তমানে একটি সেভেন স্টার মানের হোটেল ) । উমেদ ভবনে আঠারো এবং উনিশ শতাব্দীর বেশ কিছু ক্লাসিক মডেল এর গাড়ির সংগ্রশালা আছে । যা কার লাভার্স দের জন্য
একটি স্বর্গরাজ্য । সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে , রাতে হোটেল এর আশে পাশে ঘোরাফেরা করি এবং বাইরে একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাই ।
-নভেম্বর – সকালের নাস্তা শেষে যোধপুর থেকে আজমীরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই । আজমীর পৌছাই দুপুর ২ টায় । হোটেলে চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে আজমীর শরীফে যাই এবং সেখানের দর্গা দেখার পর, দর্গার বাইরের একটা হোটেলেই দুপুরের খাবার খাই । এবং খাবার খেয়ে পুস্কার যাই । যা আজমীর থেকে
মাত্র ৪০ কিমি দূরে । পুস্কারে ক্যামেল রাইড নেয়া যায় এবং মূলত এটি একটি পুরো ডেজার্ট এলাকা । পুস্কার থেকে হোটেলে ফিরে আসি সন্ধায় । এবং রাতে আজমীর শহর পায়ে হেটে ঘুরি , এবং বাইরে একটি হোটেলে খাবার খেয়ে হোটেলে এসে পড়ি ।
নভেম্বর – আজমীর থেকে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা দেই । সকাল ৯ টায় রওনা দেই এবং দিল্লী পৌঁছাই সন্ধার পরে । সেদিন ফ্রেশ হয়ে , হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি ।
নভেম্বর – দিল্লিতে আমরা যেই এরিয়ায় উঠি তার নাম করলবাগ । বেশিরভাগ টুরিস্ট এই এলাকাতেই উঠে । এখানে শপিং করার জন্য রয়েছে হাজারো দোকান । এবং শপিং করার জন্য প্রাইজ অনেক রিজেনেবল । কলকাতা থেকে দিল্লী শপিং এর জন্য ভালো । এই দুই দিন আমরা শুধু শপিংই
করি , এবং দিল্লীর ফেমাস ফুড আইটেম গুলো ট্রাই করি । দিল্লীর মিষ্টির দোকান বেশ বিখ্যাত । অনেকরকম মিষ্টী পাওয়া যায় । তাই মিষ্টান্ন প্রিয় দের জন্য এটা স্বর্গরাজ্য ।
নভেম্বর – সকাল ৮ টার ফ্লাইটে আমরা দিল্লী থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেই । এবং কলকাতায় পৌঁছাই সকাল ১০ টায় । ট্যুর কম্পানির প্যাকেজ ছিলো দিল্লী পর্যন্ত । কলকাতায় নেমে উবারে করে পার্ক্সট্রিট এরিয়ায় যাই । এবং সেখানে হোটেল ঠিক করে উঠি ।
নভেম্বর – কলকাতায় আমরা মূলত মেডিকেল ট্রিটমেন্ট এর জন্য যাই । তবে এরই ফাকে একে একে আমরা কলকাতার বিখ্যাত জায়াগা গুলো ঘুরে দেখি । ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল , রবিন্দ্র সরোবর , হাওড়া ব্রিজ এবং আরো বিখ্যাত জায়গা গুলো ।
হোটেল:
যখন যে জায়গায় যে হোটেলে ছিলাম সেগুলোর নাম দিয়ে দিলাম , হয়তো আপনাদের সুবিধা হবে ।
দিল্লী- Hottel Paradise Inn (চলনসই)
আগ্রা- Hotel Taj Villa (ফাইভ স্টার)
জয়পুর- Hotel Rajputana Haveli (থ্রি স্টার)
যোধপুর- Hotel Chandra Grand (ফাইভ স্টার)
আজমির- Hotel Kc Inn (থ্রি স্টার)
কলকাতা- Hotel Shonargaw (চলনসই)
দিল্লী এবং কলকাতা অনেক এক্সপেন্সিভ শহর বিধায় এ শহরে হোটেল ভাড়াও অনেক বেশি ।
ট্রান্সপোর্ট:
কলকাতা ছাড়া অন্য সব জায়গায় আমাদের সাথে ২৪ ঘন্টা গাড়ি ছিলো , যা ট্যুর কম্পানির প্যাকেজ এর সাথে ইনক্লুড ছিলো । তাই হোটেল গুলো মূল শহর থেকে অল্প দূরে দূরে থাকাতেও আমাদের কোনো সমস্যা হয় নি । এবং সব স্থানেই আমরা গাড়ির মাধ্যমেই যাতায়ত করি , যা আমাদের দিল্লী ছাড়ার আগে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দিয়ে আসে ।
আমরা গাড়ি দিয়ে টোটাল ঘুরেছিলাম প্রায় ১৮০০ কিমি । কিন্ত ভারতের রাস্তা অনেক উন্নত এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । তাই অনেক জার্নি করলেও আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হয় নি ।
খাবার:
খাবার অনেক এর জন্য একটা বড় সমস্যা হতে পারে । ইন্ডিয়ার মেক্সিমাম হোটেল ,রেস্টুরেন্টই ভেজিটেরিয়ান অর্থাৎ মাছ বা মাংস পাবেন না সহযে । আর পাওা গেলেও হয়তো সেই রেস্টুরেন্ট আপনার হোটেল থেকে অনেক দূরে । তাই একটু ঝামেলা হতে পারে । যেহেতু এক জায়গা থেকে আরেকজায়গা অনেক দূরে দূরে তাই নিজেদের কাছে হালকা কিছু স্নেক্স
প্রচুর ফলমুল , জুস এবং পানি কিনে রাখবেন । ফলমূল কেনায় ক্রিপণতা করবেন না । তাছাড়া হাইওয়ে তে যে যে জায়গা গুলোয় গাড়ি ব্রেক দিবে সে জায়গার রেস্টুরেন্ট গুলো অনেক এক্সপেন্সিভ । তাই পারলে চেষ্টা করবেন সেসব জায়গায় কিছু না খেতে , এবং খেলেও আগে দাম জিজ্ঞাস করে নিবেন ।
আমাদের সকল এয়ার টিকেট আমরা বাংলাদেশ থেকেই বুক করে যাই । ৪ জনের আসা যাওয়া সহ টোটাল টিকেট এর প্রাইজ আসে ৯৩ হাজার টাকা । কলকাতা ছাড়া অন্য সব জায়গায় যেহেতু আমরা ট্যুর এজেন্সির মাধ্যমে যাই তাই আমরা আমাদের হোটেলের বিল, গাড়ির খরচ সব একসাথে মিলিয়ে ৬২ হাজার রুপি বিল দেই ।
কলকাতার হোটেলে পার ডে ৩০০০ রুপি নেয় । এবং কলকাতায় সকল যাতায়ত আমরা উবার এর মাধ্যমে করি । কোনো জায়গায় ঘুরতে গেলে আমরা একটা খরচ প্রায়ই বাদ দিয়ে দেই । টুরিস্ট স্পট গুলোর এন্ট্রি ফ্রি । আপনি যদি ফরেনার হিসাবে ঢুকেন তাহলে হয়তো এসব জায়াগায় এন্ট্রি ফিই লাগবে প্রায় ৬/৭ হাজার রুপি পার পার্সন ।
আমাদের এ ট্যুর দিতে শপিং এবং ট্রিট্মেন্ট ছাড়া প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা খরচ হয় । যেহেতু এটা ফেমিলি ট্যুর তাই অন্যান্য ট্যুর এর সাথে
এর হিসাব মিলবে না । প্রয়োজন অনুযায়ী এই খরচ অনেক কমানো সম্ভব ।
একটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন সেখানে গিয়ে টুরিস্ট সিম কেনার পর তা এক্টিভ করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার । তাই এখান থেকেই আপনার সিম টি রোমিং করে নিয়ে গেলে অনেক সুবিধা হবে ।
এই তো ভ্রমণের অভিজ্ঞতা । আপনাদের কোনো জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় ইনবক্সে জিজ্ঞাস করতে পারেন । আর ভাই যেহেতু আমি কোন লেখক না তাই বানানের মধ্যে ভূল- ত্রুটি থাকতে পারে।
আজমীর-শরীফ | প্রথম এলো