বিনে পয়সায় জুরিখ ভ্রমণ
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সুইজারল্যান্ডের জুরিখ নিঃস্বন্দেহে একখন্ড স্বর্গের মতো। কিন্তু এ কথা সত্য যে মধ্যবিত্ত শৌখিন পর্যটকদের জন্য ইউরোপের অন্যতম ব্যয়বহুল এ শহর জুরিখ ভ্রমণ অনেকটা স্বপ্নের মতো মনে হয়। তবে মজার তথ্য হলো যে শহরে বেরুলে নিমিষেই আপনার পকেট ফাঁকা হয়ে যাবার ভয় থাকে সেই জুরিখ কিন্তু আদতে এমনটি নয়। চাকচিক্যের বাইরেও জুরিখে রয়েছে এমন কিছু দারুন জায়গা যেখানে আপনি চাইলেই ঘুরে বেড়াতে পারেন কোনো পয়সা খরচ ছাড়াই! জুরিখ ভ্রমণের ইচ্ছাটা যদি আপনার থেকেই থাকে তবে জেনে নিন এমন জায়গাগুলো সম্পর্কে –
১) অফুরন্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য
ব্যস্ততম শহর জুরিখে রয়েছে প্রাণজুড়ানো অফুরান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা আকর্ষণ করে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের। সাথে কেবল একটি ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন, ব্যাস! প্রকৃতির এই অবারিত নৈসর্গিক সৌর্ন্দয যে কেউ উপভোগ করতে পারবেন একদম বিনা টিকেটে! এর মধ্যে রয়েছে ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এর বিস্তৃত চত্বর, শহরের একদম কাছেই দেখা যাবে ছোট বড় পাহাড়ের চূড়া অথবা ‘ওল্ড টাউন’ এর পাথর এর শ্লেটের চত্বর। অথবা চলে যেতে পারেন নদীর পাড়ে নিভৃতে সময় কাটাতে। জুরিখের ব্লু লেকের স্বচ্ছ নীল জলের সৌন্দর্য যে কাউকে মোহিত করতে বাধ্য। এছাড়া শহরের পশ্চিমে শিল্প এলাকাটি ও কিন্তু দেখার মতো জায়গা!
২) পার্ক ও গার্ডেন
প্রকৃতির সবুজের মাঝে একেবারে ডুব দেবার জন্য জুরিখ হতে পারে আদর্শ স্থান। বিশেষ করে এই শহরের অনিন্দ্য সুন্দর পার্ক ভাবতে গার্ডেনগুলোয় ঢোকা মাত্র কেউ একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে। আর দারুণ ব্যাপার হলো বেশিরভাগ পার্ক ও গার্ডেনগুলোর প্রবেশ একদম ফ্রি! বাগানগুলোর দীর্ঘ সুউচ্চু বৃক্ষ সারি, চারিদিকে সবুজ নরম ঘাসের চাদর – এমন পরিবেশ কার না মন ছুঁয়ে যায়। এছাড়াও পার্কগুলোর ভেতরে আছে ছোট ছোট বাঁধানো পুকুর সাথে বিস্তৃত চত্বর.
বৃষ্টি থাকলে চলে যেতে পারেন ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ এর বোটানিক্যাল গার্ডেন এ. যা ফার্ন, অর্কিড সহ প্রায় 7000 এর বেশি প্রজাতির গাছের আবাসভূমি। এছাড়াও বেলভিওর পার্কের দৃষ্টিনন্দন ফুলেল বিছানা এবং এরকম আরো অনেক কিছু এ সবকিছুই পর্যটকদের দিতে পারে প্রকৃতির নিবিড় সৌন্দর্য উপভোগের অনুভূতি।
৩) এফ সি জুরিখ
আপনি যদি বিজ্ঞানের চেয়ে খেলাধুলা বিশেষত ফুটবল অনুরক্ত বেশি হয়ে থাকেন তাহলে জুরিখে গিয়ে এফ সি জুরিখ মিউজিয়ামটি দেখা মিস করা একদম ঠিক হবে না। কারণ সেখানে আছে ১৮৯৬ সাল থেকে এপর্যন্ত ফুটবল ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবগুলোর ইতিহাস, উন্নয়নের আদ্যোপান্ত যা ডিজিটাল স্ক্রিন ও ফটোগ্রাফে বর্ণনা করা। আর একজন ক্লাব ফুটবলপ্রেমী জুরিখে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা নিতে পারেন একদম বিনামূল্যে!
৪) ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ এর মিউজিয়াম
জুরিখের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দিকটি নিঃস্বন্দেহে এর মিউজিয়ামগুলো। জুওলজিকাল মিউজিয়ামে ডায়নোসরের কংকাল থেকে শুরু করে ম্যামথ সহ রয়েছে প্রায় ১৫০০ এর বেশি বিলুপ্তপ্রাণী এবং অগণিত প্রজাতির কীটপতঙ্গের ফসিল। যেখানে আরো রয়েছে তিমি মাছের গান শোনার ব্যবস্থা ও খালি চোখে দেখা যায় না এমন জীবাণুদের দেখার জন্য ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাসের ব্যবস্থা। একই ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংগ্রহে রয়েছে পালেওনতোলজিকাল মিউজিয়াম, এবং মিউজিয়াম অব আর্থ সায়েন্স। আর মিউজিয়ামগুলোয় এতসব অভিজ্ঞতা নেবার সুযোগ রয়েছে তাও আবার কোনো প্রবেশ ফি ছাড়াই।
৫) জুরিখের শিল্পকলা
জুরিখের ভুবনবিখ্যাত শিল্পীদের হাতের শিল্পকলাগুলো একেবারে বিনেপয়সায় দেখা পাওয়া দুষ্কর বটে তবে একেবারে অসম্ভব নয়! কেননা শহরের প্রধান দুটি আর্ট গ্যালারিতে নিৰ্দিষ্ট দিনে থাকে ফ্রি প্রবেশের সুযোগ। প্রতি বুধবার ‘kunsthaus’ গ্যালারির প্রদর্শনী এবং প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ‘Migros Museum’ এ প্রবেশ থাকে সকলের জন্য উন্মুক্ত।
৬) পাখি দেখা
পাখিদের কলতান উপভোগ করে না এমন লোক হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাখিপ্রেমীদের জুরিখ একটি স্বর্গ স্থলের মতন। নাম না জানা অসংখ্য প্রজাতির অদ্ভুত সুন্দর সব পাখির দেখা মিলবে এ শহরে। আর সবচেয়ে দারুন ব্যাপার হলো এখানে পাখি দেখতে শহরের বাইরে জঙ্গলে যাবার দরকার হয় না। জুরিখ শহর প্রতিদিন ভরে ওঠে পাখিদের মধুর গুঞ্জনে।
৭) জেমস জয়েস এর সমাধি
প্রখ্যাত আইরিশ সাহিত্যিকের নাম তো অনেকেই কম বেশি শুনেছি। তার শেষ রচনা “Ulysses” লেখার পর পরই এই জুরিখে ১৯৪১ এ তার মৃত্যু হয় এবং এখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। জগৎখ্যাত এই কবির সমাধি স্থলটি দেখতে প্রতিদিনই আসেন প্রচুর দর্শনার্থী। সমাধির পাশেই রয়েছে জেমস জয়েসের একটি মূর্তি, যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি এক হাতে পেন্সিল ও অন্য হাতে বই হাতে চিন্তারত অবস্থায় বসে আছেন। জেমস জয়েস ফাউন্ডেশন নিয়মিত আয়োজন করে বিভিন্ন কর্মশালা ও উৎসব উৎযাপন।
৮) ওয়াইল্ড লাইফ পার্ক
শহরের ব্যস্ততা থেকে বের হয়ে যদি একেবারেই নির্জনতায় ডুব দিতে চান তাহলে ওয়েস্ট লেক জুরিখের বোধহয় তুলনা হয় না। এখানকার ওয়াইল্ড লাইফ পার্ক হতে পারে আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান। বাদামি বর্ণের ভালুক, নেকড়ে, হরিণ, এল্কদের দেখা মিলে যাবে এখানে। ২ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ঘন জঙ্গলে হারিয়ে যেতে পারেন একদম ভিন্ন পৃথিবীতে!
৯) পর্বত আরোহন
জুরিখে এসে কিন্তু পর্বত আরোহনের বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না! জুরিখের কোলঘেঁষা সুউচ্চ পর্বতটির নাম Uetliberg.
ঘন জঙ্গলে ঘেরা এ পর্বতের চূড়ার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৮৭০ ফিট। পর্বত আরোহীরা Uetliberg আরোহণের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না নিশ্চয়ই। তবে এ জায়গাটি শরতেই বেশি জনপ্রিয়, কেননা বছরের অন্য সময়গুলোতে পর্বত চূড়া কুয়াশায় ঢাকা পড়ে থাকে।
১০) ক্যাকটাস
আপনি যদি ক্যাকটাস সংগ্রহের নেশা থেকে থাকে তাহলেই অবশ্যই একবার ঘুরে আসবেন জুরিখের ‘Succulent Plant Collection” থেকে। যেখানকার সংগ্রহে রয়েছে ৬৫০০ প্রজাতি এবং ৭০ বর্গের ক্যাকটাসের বৈচিত্র্য, যা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ।
১১) নির্জনতার খোঁজে
জুরিখ শহরের মাঝে একেবারেই কোলাহলের বাইরে নির্জন প্রশান্তিময় কিছুটা সময় কাটাতে চাইলে চলে যেতে পারেন ‘Grossmunster” চার্চে। যেটি বাইরের রাস্তা থেকে দেখার উপায় নেই এবং বেশ গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা। চার্চটিতে রয়েছে একটিমাত্র সরু ঢোকার দরজা। এর অদ্ভুত সুন্দর পিলারের নকশা মুগ্ধ করবে যে কেউকে। চার্চটি ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের ধর্মতত্ত্ব অনুষদের অধীনে রয়েছে। চার্চের শান্ত নৈঃশব্দ পরিবেশ প্রশান্তি দেবে যে কাউকে।
১২) সাঁতার কাঁটা
কোনোরকম খরচ ছাড়াই দর্শনার্থীগণ জুরিখের লেকগুলোতে সাঁতার কাটতে পারেন ইচ্ছেমতো। তবে সাঁতার কাটতে চাইলে শহরের নদীগুলো অতুলনীয়। তাই এডভেঞ্চারাস সাঁতারুগণ জুরিখে সাঁতারের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন নির্বিগ্নে।
বিলাসবহুলতা ছাড়াও জুরিখের রয়েছে আরেকটি নৈসর্গিক প্রাকৃতিক রূপ। প্রকৃতি যে রূপ সম্ভার নিয়ে পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানায় একেবারে বিনামূল্যে!