আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ-ভারতের ভেতর যেন এক অন্য দেশ

২৩ এপ্রিল চেন্নাই থেকে ভোর ৫:০৫ এর ফ্লাইটে যখন বিমান আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে ল্যান্ড করে, তখন ঘড়িতে ৬:৪০। নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৪০ মিনিট আগেই এসে পৌঁছে গিয়েছি।

আগে জানতাম, আন্দামান রেস্ট্রিটেড এরিয়া যেখানে যেতে RAP (Restricted Area Permission) লাগে, ইমিগ্রেশনে গিয়ে এক্সট্রা সিল এবং পারমিশন স্লিপ নিতে হয়, পুরো ট্রিপে সেটা ক্যারি করতে হয় এবং ফেরার সময় সেটা জমা দিয়ে আসতে হয়। কিন্তু গিয়ে দেখি, একেবারেই কোন ঝামেলা নাই। ফরেন পাসপোর্ট আর ভিসা একজন মহিলা পুলিশ কর্মকর্তা চেক করে, কোন হোটেলে থাকবো জেনে একটা ভিজিটর গাইডলাইন দিয়ে দিলেন। কোন পারমিশন স্লিপ বা এক্সট্রা সিল কিছুরই কোন দরকার হয়নি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে আগে থেকে বুক করা হোটেল Lalaji Bayview তে চলে গেলাম। যাবার পথে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জানালাম হ্যাভলক ও নীলে যাবার কথা। একটা টিকেট এজেন্সিতে গিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে হ্যাভলক, হ্যাভলক থেকে নীল ও নীল থেকে পোর্ট ব্লেয়ারে আসার টিকেট কেটে নিলাম।

সেদিন বিকেলে আন্দামানের বিখ্যাত সেলুলার জেল, Corbyn’s Cove Beach, মারিনা পার্ক আর সেলুলার জেলের লাইট এবং সাউন্ড শো দেখে হোটেলে ফিরে আসি। পরের দিন ভোর ছয়টায় হ্যাভলকে যাবার ফেরী ধরতে হবে।

২৪ এপ্রিল হ্যাভলকের পথে যাত্রা। Sea Link নামের ফেরীতে টিকেট করা ছিলো। এছাড়াও Grean Ocean আর Makruzz নামে আরও দুটো প্রাইভেট ফেরী চলাচল করে। সরকারি ফেরী কমদামে হলেও টিকেট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ফেরী থেকে জেটিতে নেমেই হ্যাভলকের নীল জল আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। আর সেই স্বচ্ছ জলের কোরাল আর হাজারখানেক সামুদ্রিক মাছের চলাফেরা তো সাথে বাড়তি পাওনা।হ্যাভলকে হোটেল বুক করা ছিলো না। অটো ড্রাইভারকে বীচের পাশে হোটেলের কথা বলায় তিনি Green Valley Resort এ নিয়ে যান। বিজয়নগর বীচের পাশের এই রিসোর্ট এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায়। ফ্রেশ হয়ে ঘন্টাব্যাপী স্নান। ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার বীচের সৌন্দর্য ভারতেই পেয়ে যাবো, এটা কখনো ভাবা হয় নাই। নীল সবুজ জলের সেই বীচের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধতার জুড়ি মেলা ভার!

বিকেলে কালাপাথর বীচ আর এশিয়ার সেরা বীচ খ্যাত রাধানগর বীচে ঘুরে আসি। প্রত্যেকটা বীচ নিজ নিজ সৌন্দর্যে ভরা। তারো সাথে কারো তুলনা হয় না। আর রাধানগর বীচ সত্যিই অসাধারণ! কি এক অপূর্ব মোহনীয় শক্তি আছে এই বীচের যে ফিরে আসতে ইচ্ছা করে না।

২৫ এপ্রিল প্ল্যান ছিলো এলিফ্যান্ট বীচে স্নরকেলিং করার। কিন্তু কোন এক দুর্ঘটনার কারণে স্নরকেলিং বন্ধ থাকায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। স্কুবা ডাইভিং এর সুযোগও আছে হ্যাভলকে কিন্তু একটু বেশিই খরচসাপেক্ষ। হ্যাভলকের শেষ রাতে কোকো রিসোর্টে একটু গ্রান্ড ডিনারই করে ফেললাম।

২৬ তারিখ সকাল ৯ টায় Sea Link এ করেই নীল আইল্যান্ডে যাত্রা। এক ঘন্টা লাগে পৌঁছাতে। নীলে নেমেও এক অন্যরকম ভিউ আপনাকে নাড়া দেবে। হ্যাভলকের তুলনায় নীল বেশ ছোট একটি দ্বীপ। আর সুযোগ সুবিধাও কিছুটা কম। তবে সৌন্দর্যে কোনোভাবেই কম নয়। অটো ঠিক করে আবারও বীচের পাশাপাশি এক রিসোর্টে যাত্রা। রিসোর্টের নাম Break Water Resort। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে সেই অটোতে করেই ন্যাচারাল কোরাল বীচে গেলাম। তারপরে ভরতপুর বীচে গ্লাস বোটিং এ্যাক্টিভিটি করি। সামুদ্রিক মাছ আর কোরাল কাছ থেকে দেখার জন্য যথেষ্ট ভালো একটা সুযোগ থাকে গ্লাস বোটিং এ। আরও অনেক এ্যাক্টিভিটি করার সুযোগ আছে ভরতপুর বীচে। বিকেলে সানসেট দেখতে লক্ষণপুর বীচে যাত্রা। আমার দেখা অন্যতম সেরা একটি বীচ এই লক্ষণপুর বীচ। বীচ থেকে বাজারে গিয়ে হোটেলে ফেরা। রাতের ডিনারে এই রিসোর্টের হোটেলের রেড স্ন্যাপার মাছের ফিশ কোকোনাট কারি অসাধারণ ছিলো। পরদিন সকালেই পোর্ট ব্লেয়ারে আসার ফেরী ধরতে হবে।

২৭ এপ্রিল পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছাতে দুপুর বারোটা বেজে যায়। এবারে বুক করা হোটেল RNP তে যাওয়া। বিকেলে এবারডিন জেটিতে গিয়ে পরেরদিন রস আইল্যান্ডের টিকেট কেটে আনি। কেউ চাইলে সাথে নর্থ বে তেও যেতে পারেন। তারপরে পোর্ট ব্লেয়ার শহরটাই আরো ভালোভাবে ঘুরে দেখা। রামকৃষ্ণ মিশন, এ্যাকুয়ারিয়াম, নেতাজী স্টেডিয়াম, শিশু পার্ক, কলেজ, এবারডিন বাজার, মারিনা পার্ক সবকিছু ভালোমতন ঘুরে খেয়েদেয়ে আবার হোটেলে ফেরত আসা।

২৮ এপ্রিল ছিলো আন্দামানে আমাদের শেষ দিন। সকাল ৯ টায় রস আইল্যান্ডে বোটে করে যাওয়া। হাতে দেড় ঘন্টা সময় ছিলো রস আইল্যান্ড ঘুরে দেখার। প্যারিস অব দ্য ইস্ট খ্যাত ০.৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট রস আইল্যান্ডে তখন ৫০০ লোকের বসবাস ছিলো। ১৯৪১ সালের ভূমিকম্প আর ১৯৪২ এ জাপানি আক্রমণে জর্জরিত রস আইল্যান্ডে কোনো মানুষ বসবাস করে না। কিন্তু তখনকার ব্রিটিশদের বাংলো, পাওয়ার হাউজ, প্রিন্টিং প্রেস, বেকারি, গ্রোসারি, সুইমিংপুল, বীচ, চার্চ, পুকুর, সিমেট্রি সবকিছুর ধ্বংসাবশেষ দেখতেই সময় কেটে যায়। এই ছোট্ট দ্বীপেও ফেরার বীচ নামে খুব সুন্দর একটা বীচ আছে। রস আইল্যান্ড থেকে ফিরে এসে জেটির সুন্দর বাতাসে দুই ঘন্টা বসে ছিলাম। তারপরে খেয়েদেয়ে হোটেলে ফিরে আসি। হাতে সময় থাকলে পোর্ট ব্লেয়ারে আরও বেশ কিছু ঘোরার মতন জায়গা আছে।

২৯ এপ্রিল সকালের ফ্লাইটে কোলকাতা আর তারপরে বিকেলে ঢাকায় ফিরে আসা। আর জ্যামে বসে ৬ দিনের এই অসাধারণ আন্দামান ট্রিপের কথা মনে করতে করতে একসময় বাসায় চলে আসি।

কিছু বিশেষ টিপস :
১. সমুদ্র দেখতে যারা বালি বা মালদ্বীপে যেতে চান, কম খরচে সেগুলোর বিকল্প হতে পারে আন্দামান। কোলকাতা – পোর্ট ব্লেয়ার – কোলকাতা রিটার্ন এয়ারফেয়ার সর্বোচ্চ ১২০০০ রুপিতেই পেয়ে যাবেন।

২. আমাদের পুরো ট্রিপের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো Vodafone সিম নিয়ে যাওয়া। আন্দামানে গেলে অবশ্যই BSNL বা Airtel সিম নিয়ে যাবেন। Wifi সুবিধা ভালো না এবং বেশিরভাগই পেইড।

৩. অফ সিজন ছিলো বলে ফেরীর টিকেট এবং হোটেল পেতে আমাদের তেমন অসুবিধা হয়নি। এগুলো অবশ্যই অনলাইনে আগে বুক করে যাবেন।

৪. স্কুটি চালাতে যারা পারেন, তারা হ্যাভলক এবং নীলে গিয়ে স্কুটি ভাড়া করে পুরো সময় ঘুরতে পারবেন। খরচ অনেক বেঁচে যাবে।

৫. একটু বেশি খরচ হলেও বীচের ধারে রিসোর্ট নিলে সকালে ও রাতে বীচের ঠান্ডা বাতাস পাবেন।

৬. দ্বীপ বলে খাবারের খরচ একটু বেশি এবং স্ট্রিটফুড নেই বললেই চলে। তাই খাবারে একটু হিসাব করে চলা উচিত।

৭. আন্দামানের ৯০ ভাগ মানুষ বাঙালি। তাদের বেশিরভাগেরই শেকড় বাংলাদেশে। তাই স্থানীয়দের কাছে খুবই সম্মান ও সহায়তা পাবেন।

৮. পোর্ট ব্লেয়ারে The hub এবং Annapurna Cafeteria তে খেতে ভুলবেন না।

খরচ:
১. প্লেন ভাড়া সম্পর্ক আগেই বলেছি। কোলকাতা – পোর্ট ব্লেয়ার – কোলকাতা রিটার্ন এয়ারফেয়ার ১২০০০ রুপিতেই পেয়ে যাবেন।

২. পুরো ট্রিপে ৩টা ফেরীতে খরচ ছিলো ৩৬০০ রূপির মত। তবে ফেরী কোম্পানি এবং ইকোনমি – বিজনেস ক্লাস ভেদে খরচ কিছুটা কম বেশি হতে পারে।

৩. পোর্ট ব্লেয়ার থেকে রস আইল্যান্ডের বোটের টিকেট ৩৫০ রুপি। সাথে নর্থ বে কভার করলে ৭৫০ রুপি।

৪. গ্লাস বোটিং এ্যাক্টিভিটি ৫০০ রুপি। স্নরকেলিং ৮০০ এবং স্কুবা ডাইভিং ৩৫০০ রুপি।

৫. প্রতি বেলায় খাবারে প্রায় ২২০-২৫০ রুপি লাগবে। ট্যুরিস্ট প্লেস এবং দ্বীপ হওয়ায় খাবারের খরচ একটু বেশি।

৬. হ্যাভলক ও নীলে সারাদিনের জন্য স্কুটি ভাড়া ৫০০ টাকা। অটো নিলে কিছুটা বেশি পড়বে। গাড়ি নিলে আরও বেশি পড়বে।

Source: Sushanto Saha‎ Travelers Of Bangladesh (TOB)

Share:

Leave a Comment