মেঘালয়ের শিলং-চেরাপুঞ্জি ভ্রমণ গল্প

মেঘ আর পাহাড় সবসময় মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়।সে সুবাদে আমরা ৬ জনের গ্রুপ মিলে শিলং যাবার প্ল্যান করি ২ মাস আগে থেকেই।কিন্তু ভিসা না হওয়ার কারণে ৩ জন বাদ পরে যায় ট্যুর থেকে।তাই ৩ জন মিলেই ১০ জুন ১২.১৫ এর এনা বাসে মহাখালী থেকে শুরু করি জার্নি। বাসে যাবার কারণ হলো সেফটির জন্য আমরা চাচ্ছিলাম যে যাতে আমাদের মালপত্র গুলো ঠিকঠাক থাকে।

দিন ১ঃ সকাল ৬ টায় সিলেট পৌঁছে নাস্তা করে লোকাল বাসে না উঠে সিএঞ্জি ঠিক করি তামাবিল বর্ডার পর্যন্ত ৬০০ টাকাতে।এরপর সকাল ৮.৪৫ সকাল 8 টা 45 এ তামাবিল বর্ডার পৌঁছে ১৫-২০ জন পর ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস এর কাজ শেষ করে ভারতীয় ইমিগ্রেশন এ প্রবেশ করি। ভারতীয় ইমিগ্রেশন কিন্তু পুরোটাই একদম অ্যানালগ। ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করে দেখি যে আমাদের সামনে প্রায় 50 জন লোক আছে। সেখানে পাসপোর্ট জমা দেই, তারপর প্রায় এক ঘন্টা পর আমাদের তারা ডেকে নিয়ে তাদের যে লিস্ট আছে সেই লিস্টে আমাদের সাইন করায়। এরপর শুরু হয় আমাদের আসল বিড়ম্বনা যেহেতু আমরা কোন রকমের ডলার এনডোর্সমেন্ট করে নিয়ে যায় নি সেহেতু ইন্ডিয়ান কাস্টমস আমাদের সাথে কিছুটা ঝামেলা শুরু করে। তারপরও সেখানে আমরা টাকা দিয়ে পার হই। বলে রাখা ভালো যেহেতু আমরা তিনজন ছিলাম কিন্তু গাড়ি পাওয়া যায় চারজনের সেহেতু আমরা আরো একজন ট্যুর মেম্বার কিন্তু বর্ডার থেকে এড করেছিলাম। তারপর বর্ডারের সকল কাজ শেষ করে ডাউকি টু উমেক্রম ফলস,লিভিং রুট ব্রীজ,মাউলিনং ভিলেজ ঘুরে সন্ধ্যা ৭ টায় শিলং পৌঁছে হোটেল নেই ২০০০ রুপি দিয়ে ৪ জনের জন্য।হোটেলের নাম ছিল হোটেল অতিথি। সেদিনের জন্য আমাদের গাড়ি ভাড়া পড়েছিল ১৮০০ রুপিতে।বড়হিল ঝর্ণা যাবার রাস্তা খারাপ হওয়ায় ড্রাইভার যেতে চায় নি

দিন ২ঃ সকাল সাতটায় হোটেল চেক আউট করে চেরাপুঞ্জির ওকাহাবা ফলস, নোকালিকাই ফলস, সেভেন সিস্টার্স ফলস, মোয়াসামি গুহার জন্য গাড়ি ঠিক করি ২০০০ রুপিতে।বলে রাখা ভালো আপনি ওকাহাবা ফলসে গোসল করতে পারবেন।আর প্রতিটি স্পটেই পার্কিং চার্জ আর এন্ট্রি ফি আছে।এসব স্পট ঘুরে শিলং আসার মাঝপথে জিপ লাইনিং এর জন্য বিরতি নেই তারপর রাতে এসে হোটেল খোঁজাখুঁজি করে ১৫০০ রুপিতে হোটেল অনুরাধা ঠিক করি।
দিন ৩ঃ তৃতীয় দিন সকালে নাস্তা করে লাইটলুম, উমিয়াম লেক, শিলং গলফ ক্লাব, ওয়ার্ড লেক, এলিফ্যান্ট ফলস এবং সেখান থেকে রাতে ডাউকি ফেরবার জন্য গাড়ি ঠিক করি 3200 রুপি দিয়ে। এলিফ্যান্ট ফলস এ যাবার আগে আমরা শপিং এর জন্য বেশি সময় বিরতি নেয়ায় ড্রাইভার আমাদের এলিফ্যান্ট ফলস যাবার পর ব্ল্যাকমেইল শুরু করে বলে সে ডাউকি যাবে না।কিন্তু যেহেতু আমাদের ডাউকিতে ক্যাম্পিং করার ইচ্ছা ছিল তাই তাকে আরো ৮০০ রুপি বাড়িয়ে দিয়ে সন্ধ্যা ৭.৩০ এ ডাউকি পৌঁছাই এবং ক্যাম্পিং এর জন্য তাবুভাড়া নেই ১২০০ তে রুপিতে ৪ জন।এরপর রাতের ডিনার করে সারারাত ক্যাম্পিং করি ডাউকি উমগট নদীর তীরে।সেখানে ক্যাম্পিং না করে ডাউকি বাজারে হোটেলে থাকাই ভালো বলে মনে করি
দিন ৪ঃ সারারাতের বৃষ্টি সকাল ধরেই চলছিল। তাবুতে শুয়ে নদী দেখছিলাম আর বৃষ্টির শব্দ ভালোই লেগেছিল। এর পর ডাউকি বাজারে যেয়ে সোনাংপেডাং,ক্রাংসুরি ফলস ঘুরিয়ে ডাউকি বর্ডারে ড্রপ করার গাড়ি ঠিক করি ১১০০ রুপি দিয়ে।ক্যাম্পিং সাইটে গাড়িকে দাঁড় করিয়ে ডাউকি ঝুলন্ত ব্রীজের নিচে দিয়ে আমরা Boating করি।boating এর ফি ৭০০ রুপি কিন্তু সকাল ১০ টার আগে করেছি বলে ৫০০ রুপিতে রাজী হয়েছিল।কেননা তখন ইউনিয়ন এর অধীনে থাকে না নৌকার মাঝিরা।এরপর সোনাংপেডাং আর ক্রাংসুরি ঘুরে বিকেল ৪ টায় বর্ডার ক্রস করে সিএঞ্জি ঠিক করি আবার ৬০০ টাকা দিয়ে সিলেটের জন্য।সন্ধ্যা ৭.৩০ এর সিলেট নেমে ৮ টার বাসে উঠে ১৪ জন দিবাগত রাত ২ টা বা ১৫ জুন ভোররাত ২ টায় ঢাকা এসে পৌঁছাই

মেঘালয়ের আরো কিছু তথ্যঃ
১.প্রথম দিনের ট্যুর ভালো লেগেছে উমেক্রম ফলস।মাউলিনং ভিলেজ আর লিভিং রুট ব্রীজ ভালোই তবে ওভার রেটেড মনে হয়েছে।আর ডাউকি থেকে শিলং যাবার রাস্তা খুব সুন্দর।৩ ঘন্টা লাগে যেতে।মাঝে ভিউ পয়েন্ট আছে কিছু।ড্রাইভারকে বললেই থামিয়ে দেখাবে।
২.দ্বিতীয় দিনের চেরাপুঞ্জির সবচেয়ে বেস্ট নোকালিকাই ফলস আর ওয়াকাহাবা ফলস।মাঝপথে জিপ লাইনিং করতে পারেন সেক্ষেত্রে ৪০০ রুপি পড়বে ছোট স্টেপ আর বড় স্টেপসহ ৮০০ রুপি।
৩.তৃতীয় দিনের বেস্ট প্লেস লেগেছে লাইটলুম।পুরো ট্যুরের এটা বেস্ট।উমিয়াম লেককে ড্রাইভাররা বড়পানি হিসেবে চিনে।এটাতে ঢুকতেও এন্ট্রি ফি লাগে।তবে ব্রীজের উপর থেকে দেখতে এন্ট্রি ফি লাগে না।ভিতরে প্রবেশ করে দেখার আসলে কিছু নেই।ব্রীজ থেকেই ভালো ভিউ আছে।শিলং গলফ ক্লাব আর ওয়ার্ড লেক পুরাপুরি ওভাররেটেড।ইলেফেন্ট ফলসের ৩ টা স্টেপ আছে।সবচেয়ে নিচের স্টেপে যেতে ১০ মিনিট লাগবে।
৪.চতুর্থ দিনে ডাউকির Boating মিস করবেন না।সোনাংপেডাং এও Boating করবেন।আর ক্রাংসুরিতে গোসল করতে হলে লাইফ জ্যাকেট লাগবে ৫০ রুপি ভাড়া দিয়ে আর প্রবেশ টিকেট ৪০ রুপি।ক্রাংসুরি তে যেতে ১০ মিনিট লাগবে নিচে নামতে
৫.শিলং শহরে প্রচুর ট্রাফিক জ্যাম হয় তাই খুব ভোরে ট্যুর শুরু করবেন
৬.প্রচুর দরদাম করতে হবে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে
৭.হিন্দি না জানলেও সমস্যা নাই,প্রায় সবজায়গাই বাংলা চলে।আর ইংলিশ প্রায় সবাই জানে
৮.শপিং করার জন্য শিলং না,দাম অনেক বেশি।তবে ভিশাল সুপারশপে এখন অফার চলছে অনেক, যেতে পারেন
৯.শিলং এর প্রতিটি স্পটেই পার্কিং ফি+এন্ট্রি ফি লাগে নোকালিকাই আর এলিফ্যান্ট ফলসে ক্যামেরা ফি লাগে
১০.ভারত পর্যটন শিল্পে এগিয়ে আছে কারণ তারা পর্যটকদের নিরাপত্তায় অনেক গুরুত্ব দেয়
১১.শিলংয়ে স্থানীয় বা ড্রাইভারদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সেখানে চোর-পকেটমার এসব নেই।তবে সাবধান থাকা ভালো
১২.শিলংয়ে প্রি-এক্টিভ সিম কিনতে পারবেন না।প্রায় ৭ দিন লাগে সিম একটিভ হতে।হোটেল ওয়াফাইও খুব একটা ভালো না।নেটওয়ার্ক নিয়ে ঝামেলায় আছে
১৩.আপনি মুসলিম হলে, যে হোটেলে পর্ক আছে সেখানে না খাওয়াই ভালো। আমরা খাই নি,নুডুলস খেয়ে তখন ক্ষুধা মিটিয়েছিলাম।পরে শিলং এসে বা যে হোটেলে পর্ক নেই সেখানে খেয়েছি
১৪.ডাউকি বাজারে টাকা টু রুপি রেট ভালো আর শিলংয়ে ডলার থেকে রুপি
১৫.ডলার এন্ডোর্স ছাড়া কেউ গেলে ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন ইন্ডিয়ান বর্ডারে
এই সম্পুর্ণ ট্যুরে ঢাকা-শিলং-চেরাপুঞ্জি-ঢাকা পর্যন্ত আমাদের প্রায় ৭০০০ টাকার মতো খরচ হয়েছে ট্রাভেল ট্যাক্স,খাওয়া-দাওয়া,হোটেল খরচ সব কিছু সহ।

Source:  Shovon Jubayer‎ <Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment