স্টকহোম, সুইডেন ভ্রমণ গল্প
অনেকেরই ধারণা যে প্রতিবেশী দেশে রেষারেষি-মারামারি বোধহয় এশিয়াতেই বেশী। যেমন ভারত-পাকিস্তান, ভারত-বাংলাদেশ, চীন-ভারত। ইউরোপীয়ান দেশেগুলোর ভেতর বোধহয় যাকে বলে গলায় গলায় ভাব-ভালবাসা ।
.
কিন্তু আদতে ব্যপারখানা যে মোটেও যে অত ভালবাসাবাসির নয়, বরং জি-বাংলার সিরিয়ালের মত ওদের ভেতরেও যে যথেষ্টই কূটনামী-হিংসা-রেষারেষি আছে তা টের পেয়েছিলাম প্রথম কয়েকবার ইউরোপে গিয়েই । তবে এবার আরও ভাল করে টের পেলাম স্টকহোমে গিয়ে ।
.
স্টকহোম, সুইডেনের রাজধানী । প্রতি ঈদের সময় কয়েদিনের জন্য যখন ঢাকা শহর খালি হয়ে যায়, নিরব শহরের জ্যামহীন রাস্তায় গাড়িগুলো যখন লাগাম-খোলা ঘোড়ার মত দৌড়ে বেড়ায় তখন ঢাকা শহরে থাকা প্রত্যেকেরই একবার হলেও মনে হয় “ইশ্ ! সব সময় যদি ঢাকা শহরটা এমনই থাকত !” স্টকহোমে পা দিয়ে সবচেয়ে প্রথম আমার মনে হলো এযেন ঠিক সেরকমই একখানা শহর । বড় বড় দালান-কোঠা, অফিস-আদালত, গাড়ি-ঘোড়া সবই আছে কিন্তু শুধু যেন মানুষগুলোই নেই । থাকলেও খুব কম । নিরব-নিস্তব্দ, ছিম-ছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন । হুশ-হাশ বেরিয়ে যাওয়া গাড়ি, নিময়মাফিক আশা-যাওয়া করা হলদে রংয়ের বাস আর মেট্রোরেল… … ব্যস্ততার ছাপ বলতে এটুকুই ! বাইরে থেকে দেখলে মনে যেন পুরো শহরটিই ছুটি কাটাচ্ছে । তবে পার্থক্য হলো ওদের এই ছুটি ছুটি রেশ সারা বছরজুড়েই থাকে, আর আমাদের মাত্র এক সপ্তাহ । তবে কি ওরা কাজ করে না ? অবশ্যই করে । না হলে দেশটা চলে কি করে ! কিন্তু ম্যাজিকটা হলো প্রথমত, ওদের কাজের এফিসিয়েন্সী । সুইডেনের ঘন্টা প্রতি প্রডাক্টিভিটি পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ এবং বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ২৮ গুণ । অর্থাৎ, প্রতিজন সুইডিশ প্রতিঘন্টায় প্রতিজন বাংলাদেশীর তুলনায় ২৮ গুণ বেশী উৎপাদন করেন ! দ্বিতীয়ত, স্টকহোমের আয়তন ঢাকা শহরের তিন-ভাগের-দুই-ভাগ হলেও লোকসংখ্যা ঢাকায় পনের ভাগের একভাগ – মাত্র দশ লাখ । তাই পুরো শহরটাই নিরিবিলি আর জনবিরল ।
.
যা হোক বলছিলাম প্রতিবেশী দেশের রেষারেষির কথা । সুইডেনে গিয়ে দেখলাম ওদের মত নিরীহ-চুপচাপ দেশেরও একখানা জাতশত্রু আছে । এবং সে আর কেউ না, পাশের দেশ ডেনমার্ক ! ঠান্ডা-পরিচ্ছন্ন-পরিষ্কার বাতাসের এই দুই নরডিক দেশ একে অন্যের সাথে একবার নয়, দু-বার নয়, তিন বার নয়, একে একে অন্ত:ত এগারো বার যুদ্ধে জড়িয়েছে ! অবস্থা এমন ছিল যে ডেনমার্কে কিংবা সুইডেনে কোন নতুন রাজা সিংহাসনে বসলেই খামোখাই একে অন্যকে আক্রমন করে বসত, ব্যপারটা অনেকটা ইজ্জত বাড়াবার মত । এর ধারাবাহিকতায়ই আজ থেকে ঠিক পাঁচশ বছর আগে ১৫২০ সালে ঘটে গেল এক রক্তাক্ত ঘটনা, ইতিহাসে যাকে ‘স্টকহোমের রক্তগঙ্গা’ বলে । ডেনমার্কের সিংহাসনে নতুন বসা ‘খ্রিস্টিয়ান দ্য সেকেন্ড’ প্রথমেই নিজের ইমেজ বাড়াতে যথারীতি স্টকহোম দখল করে নিজেকে ডেনমার্ক ও সুইডেন দুই দেশেরই সম্রাট ঘোষনা করেন । স্টকহোম দখলের পর নভেম্বরের ৭ তারিখ কৌশলে সুইডেনের বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সেনাধ্যক্ষ, অভিজাত ব্যক্তিবর্গকে ডেকে নেয়া হয় দূর্গে । তারপর একে একে তিন দিনে প্রায় ৮২ জনকে হত্যা করা হয় নিরস্ত্র অবস্থায় । এই ঘটনা ডেনমার্কে-সুইডেনের মধ্যেকার তিক্ততা আজীবনের জন্য খাদে ফেলে দেয়, যার রেশ এখনও আছে । সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ট্যুর গাইড প্রত্যেকে এই ঘটনার কথা অত্যন্ত তিক্ততার সাথে বর্ণনা করে ডেনমার্কের কথা উঠলেই ।
.
মার্কেটিংয়ের উপর কোর্স করতে অফিস থেকে এবার আমায় পাঠানো হয়েছিল স্টকহোমের বিখ্যাত IHM Business School এ । তিনদিনের কোর্সের চাপে ঘোরার সময় খুব বেশী একটা পাইনি । তারপরও ক্লাস শেষে বিকেলে একটু একটু করে ঘুরে বেড়িয়েছি স্টকহোমের পুরানো অংশে, যেখানে আছে শত শত বছরের পুরানো সব গির্জা, দূর্গ, রাজার প্রাসাদ, বাগান, জাদুঘর আর পুরানো স্কয়ার । শহরের এই অংশটায় পা দিলে মনে হয় হুট করে যেন তিন-চারশ’ বছর আগে ফিরে গিয়েছি – সেই পুরানো ধাঁচের বিল্ডিং, দোকানপাট, পাথরের রাস্তা আর ক্যাফেতে কম্বল পেতে বসে বিশাল বিশাল মগে ধোঁয়া ওঠা কফি খাওয়া ।
.
স্টকহোমকে বলা হয় দ্বীপের শহর । কারণ, পুরো শহরটি আসলে চৌদ্দটি দ্বীপের সমন্বয়ে তৈরী । তাই শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে অনেকগুলো খাল আর লেক, যেগুলো গিয়ে যুক্ত হয়েছে বাল্টিক সাগরে । আমাদের ঢাকা শহরেও একসময় অনেকগুলো খাল-লেক ছিল, যা আমাদের শহরটিকে যুক্ত করেছিল একপাশে বুড়িগঙ্গা আরেক পাশে বালু-শীতলক্ষ্যার সাথে । পার্থক্য হলো আমরা নিষ্ঠুর পাষাণের মত একে একে গলাটিপে হত্যা করেছি আমাদের খাল, লেক আর নদীগুলোকে । আর ওরা পরম মমতায় ওদের প্রতিটি খাল-লেক-আর জলধারাকে আগলে রেখেছে, বাড়িয়ে তুলেছে শহরের সৌন্দর্য, করে নিয়েছে নিজেদের আত্মীয়ের মতই আপন ।
.
আবহাওয়ার ব্যপারে বললে সুইডেন চির-ঠান্ডার দেশ । গতমাসে আমি যখন গিয়েছি তখন রাতে তাপমাত্রা রীতিমত ২ ডিগ্রীতে নেমে যেত, আর দিনের বেলায় খুব বেশী হলে ১৩-১৫ ডিগ্রী, সাথে ঠান্ডা বাতাস । সুয়েটার-জ্যাকেট গায়ে চাপিয়েও আমার যখন দাঁত লেগে যাবার মত অবস্থা আমার কলিগরা তখন আমাকে দেখে হাসে আর বলে “এটা কোনও ঠান্ডা হলো ! এখন তো চমৎকার বসন্তকাল ।” আমি বলি ভাইরে, আমি ৩৮ ডিগ্রীর দেশের মানুষ । আমার জন্য ৫ ডিগ্রী মানে ফ্রীজে বসে থাকা । আর সুইডেনের মত চিটিংবাজ সূর্য আর কোথাও দেখিনি ! সকাল হতেই দেখা যায় ঝাঁ-চকচকে একখানা সূর্য উঠেছে । রুমের ভেতর থেকে বাইরে তাকালে রোদের উজ্জ্বলতা দেখে মনে হবে কত যেন গরম । কিন্তু সেটি ভেবে খালি যদি গরম কাপড় না পরে বাইরে বেরিয়েছেন, তো মরেছেন ! বাইরে পা দিয়েই দেখবেন কোথায় গরম আর কোথায় কি ! বরং ঠান্ডায় দাঁত লেগে যাবার উপক্রম হবে !
সেদেশের সূর্যিমামা অনেকটা টর্চলাইটের মত – শুধু আলো দেয়, উত্তাপ না ! তাই বাইরে সূর্যের আলো দেখে খুশিতে কিংবা ঠ্যালায় গরম কাপড় না নিয়ে ঘোরতে বের হয়ে পরবেন না । এদেশের মানুষ সৎ এবং সত্যবাদী হলেও, তাঁদের রেপুটেশনের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে সূর্যিখানা যথেষ্টই চিটিংবাজ বটে !
.
চারদিন পর যখন স্টকহোম থেকে বের হয়ে বার্লিন যাচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল এত শত শত বছরের রাজনৈতিক বিদ্বেষ-হানাহানি-তিক্ততা থাকলেও কি চমৎকারভাবে সুইডেন-ডেনমার্ক দু-দেশই এখন রেষারেষি দুরে রেখে একে অন্যের সাথে অর্থনৈতিক উন্নতিতে কাজ করছে । একসাথে ব্যবসা করছে, একে অন্যের এয়ারপোর্ট ব্যবহার করছে, রাস্তা-ব্রীজ বানিয়ে পাসপোর্ট ছাড়াই বাঁধাহীন যাতাযাত করছে, বিদ্যুৎ-জ্বালানী দেয়া-নেয়া করছে, একে অন্যের দেশে ফ্যাক্টরী বসাচ্ছে, এমনকি যৌথভাবে বিরাট বিরাট প্রতিষ্ঠানও চালাচ্ছে । অথচ উপমহাদেশের আমরা হাজার হাজার বছর একসাথে একপরিবারের মত বসবাস করার পর মাত্র ৭০ বছর আগে আলাদা হয়ে গেলাম । তখন থেকে একে অন্যের সাথে খালি যুদ্ধ আর একে অন্যের পাতে খালি বিষই ঢেলে যাচ্ছি । এতে করে দিন শেষে কেউই কিন্তু লাভবান হচ্ছি না, সবাই মিলেই বরং পেছনে পরে রইলাম । কবে আমাদের বুঝ আসবে, কবে আমরা একে অন্যকে পেছনে না টেনে সামনের দিকে ঠেলে নেব কে জানে ।
Source: