চুয়াডাঙ্গা-ঢাকা-কক্সবাজার-ঢাকা-কুয়াকাটা-চুয়াডাঙ্গা ভ্রমণ

পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন বালুকাবেলার সমুদ্র সৈকত আমাদের এই বাংলার মাটিতে। ভারত মহাসাগরের উত্তর অংশে অবস্থিত একটি ত্রিভূজাকৃতির উপসাগর হচ্ছে বঙ্গোপসাগর যার উত্তরে প্রায় ১২৩ কিলোমিটারের মতো দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আমাদের প্রকৃতিকে করেছে বৈচিত্রময়। আমার এবারের ভ্রমণ টা ছিল এই সমুদ্র সৈকত কে ঘিরেই।

নিজের দেশে কখনোই বিশেষ কোনো পরিকল্পনা করে ভ্রমণ করা হয় না আমার। বিষয় টি অনেকটা এরকম যে, পথ ই ঠিক করে দিবে পথিকের গন্তব্য। তবে যেখানেই ভ্রমণ করি না কেনো বিশেষ কোনো তাড়াহুড়ো থাকে না আমার। অনেকটা ধীরে ধীরে, দুলকি চালে কিছুটা অলস সময় কাটানো আরকি।

যথারীতি রাতের গাড়িতে চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। ঢাকাতে একটা দিন বিশ্রাম নিয়ে আবার কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা। কক্সবাজার এর আগেও দু’বার গিয়েছি। তাই একা মানুষ হলেও তেমন ভাবনা ছিল না। Route এবং Tour Plan মুখস্থ। কক্সবাজার যে কয়দিন ই থাকি না কেনো একবারের বেশি সমুদ্র স্নান করা হয় না আমার। তার চেয়ে শেষ বিকেল থেকে শুরু করে মাঝরাত অবধি সমুদ্র সৈকতে বসে থাকতেই আমার দারুণ ভালো লাগে।

কক্সবাজার সাধারণত শীতের মরসুমে পর্যটকদের চলাফেরাতে মুখরিত হয় কিন্তু আমার চোখে ভরা বর্ষার সমুদ্র সৈকত বেশি প্রিয়। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সাথে বহু দূর থেকে ভেসে আসা সাগরের গর্জন আমার সেই অনুভূতিগুলোকে বড় বেশি মোহনীয় করে তোলে। বর্ষার মরসুমে পর্যটকদের আনাগোনা কম থাকে তাই ৬০০-৭০০ টাকার মধ্যেও দারুণ সব হোটেল পাওয়া যায়। পাশাপাশি, রেস্টুরেন্টগুলোতেও তেমন ব্যস্ততা চোখে পড়ে না। কিছুটা সময় নিয়ে আয়েশ করে খাওয়ার মধ্যেও বেশ আনন্দ খুঁজে পাই আমি।

কক্সবাজারে যখনই গিয়েছি না কেনো ডলফিন মোড়ে নামলেই অদ্ভুত রকমের প্রশান্তিতে মনটা ভরে যায়। সাধারণত ঘুম থেকে উঠতেই আমার দশটা বেজে যায়। এরপর গোসল করে নাশতা করে দুলকি চালে এগোতে থাকি ৬ নম্বর ঘাটের উদ্দেশ্যে। এই ৬ নম্বর ঘাটের থেকেই মহেশখালির উদ্দেশ্যে নৌকা, স্পিডবোট গুলো ছাড়ে। ইঞ্জিনচালিত কাঠের ঘন্টাখানেক আর স্পিডবোটে ২০ মিনিটের মতো সময় লাগে মহেশখালি পৌছাতে। মহেশখালি মূলত বাঁকখালি নদীর মোহনায় অবস্থিত একটি পাহাড়ি দ্বীপ। পুরাতন ধাঁচের এই দ্বীপটি তে দেখার মতো জায়গা বলতে – বৌদ্ধদের কিয়াং গুলো, লবণের ক্ষেত, পাহাড়ের চূড়ায় আদিনাথ মন্দির, আদিনাথ মন্দিরের পিছনের পাশে পাহাড়ের উপরেই ছোটোখাটো গড়নের দুইটি পুকুর এবং সবশেষে শ্যুটিং ব্রিজ। শ্যুটিং ব্রিজটি দুর্দান্ত রকমের সুন্দর। এগুলো ঘুরে কক্সবাজার ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এরপর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ি সাগরের পাড়ে। মাঝরাত পর্যন্ত টুকটাক পুরাতন দিনের গানগুলো শুনি, কখনো কখনো বহুদূর থেকে ভেসে আসা ঢেউয়ের দুর্দান্ত গর্জন। এর মধ্যে টুকটাক করে চা-কফি খেতে খেতে কখন যে চার-পাঁচ ঘন্টা কেটে যায় বুঝতেই পারি না।

পরের দিন যথারীতি একই সময়ে উঠে নাশতা করে বেরিয়ে পড়ি ইনানী’র উদ্দেশ্যে। এই পথটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসাধারণ একটি গৌরবগাঁথা। পুরো পথটাই অসাধারণ। বাম পাশে পাহাড়ের অটলতা আর ডান পাশে সমুদ্রের বিশালতা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। ইনানী’র বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে বেশ কিছু পাথর আছে। তবে অবশ্যই আমার চোখে পাথুরে সৈকত নয়। সবমিলিয়ে ঘন্টা দুই কাটিয়ে বেরিয়ে পড়ি হিমছড়ির উদ্দেশ্যে।

হিমছড়ি অসাধারণ। হিমছড়ি কে সবচেয়ে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছিল আমার বন্ধু সঞ্জয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে। সঞ্জয় ছিল আমার রুম মেট। সপরিবারে ঘুরে এলো কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি। হিমছড়ি সম্পর্কে সঞ্জয়ের মূল্যায়ন ছিল,” তুমি যদি হিমছড়ি পাহাড়ের উপর থেকে বঙ্গোপসাগর কে না দেখো তবে একজন বাংলাদেশী হিসেবে তোমার অর্ধেক জীবন ই বৃথা।” আমার চোখেও ঠিক এরকম ই মনে হয়েছে। সূর্য টা পশ্চিমাকাশে নীলের কোলে মাথা রেখে দিগন্ত রেখায় ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করে তখনো তার প্রতিবিম্ব সাগরের অজস্র জলরাশির মাঝে সোনালী সোহাগে খেলা করতে থাকে।

এবার যেহেতু কুয়াকাটা যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাই আর সময় নষ্ট করার মতো সময় ছিল না। কক্সবাজার থেকে রাতের গাড়িতে সোজা ঢাকা। ঢাকায় একদিন বিরতি নিয়ে রাতের বেলায় হানিফ পরিবহনের একটা গাড়িতে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ফেরি ঘাটে জ্যাম ছিল তাই বরিশাল পৌঁছাতেই প্রায় দশটা বেজে গেলো।

বরিশাল বাস টার্মিনাল থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। তিন ঘন্টার কিছু বেশি সময় লাগে। কুয়াকাটা পৌছিয়ে প্রথমেই Lunch করে নিলাম। এরপর দেখেশুনে একটা হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

কুয়াকাটা প্রথমবার যখন যাই সেটা ২০০৫ সালের ঘটনা। তখন সূর্যোদয় পাই নি তবে সূর্যাস্ত পেয়েছিলাম। ধীরে ধীরে সূর্য টা টুপ করে সমুদ্রের অজস্র জলরাশি র মধ্যে ডুব দিলো। তখন মোবাইল ছিল না আমাদের কারো। বন্ধু ইমরানের একটা ক্যামেরা ছিল সেটাই ছিল একমাত্র অবলম্বন। সেটাও আবার ডিজিটাল ক্যামেরা না। ছবি তুলতে হলে ফিল্ম কিনতে হতো। যাই হোক, ইমরানের ক্যামেরায় সবমিলিয়ে আমার দুইটি ছবি ছিল। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। কিভাবে যেনো পুরো ফিল্মটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ছবিগুলোর আর Print নেওয়া সম্ভব হয় নি।

এবার অনেক আশা নিয়ে এসেছি। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখবো। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু শেষ মূহুর্তে সূর্য টা হারিয়ে গেলো মেঘের আকাশে। মন খারাপ হয়নি একদম। সূর্যাস্তের কোনো ছবি না থাকলেও আমার হৃদয়ের ক্যানভাসে এখনো জীবন্ত। তবে সূর্যোদয় কোনোভাবেই মিস করা চলবে না, একদমই না। তাই আগে থেকেই একটা মোটরসাইকেল ঠিক করে রাখলাম।

একদম ঠিক সময়ে চলে এলেন ড্রাইভার সাহেব। দু’জন সাগরের তীর ধরে ছুটতে শুরু করলাম। সুনসান নীরবতা চারপাশে, সৌন্দর্য কতটা পবিত্র হতে পারে তারই একখণ্ড ছবি তখন চোখের সামনে। এগোচ্ছি ত এগোচ্ছিই, চারপাশ ফর্সা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সূর্যের কোনো দেখা নেই। ড্রাইভার সাহেবকে যতবার ই জিজ্ঞাসা করেছি, আর কতটা পথ পেরোতে হবে ? ড্রাইভার সাহেব ততবার ই বলে চলেছেন, আরেকটু সামনে। এই আরেকটু পথ শেষ ই হচ্ছে না। এক পর্যায়ে ড্রাইভার সাহেব ও হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, সূর্য টা মনে হচ্ছে উঠেই গেছে। মেঘে ঢাকা আকাশ, তাই ক্ষীণ আশা মনে আছে তখনো। এগোতে লাগলাম।

একটা পর্যায়ে সূর্যের দেখা পেলাম কিন্তু এতটুকু আন্দাজ করতে মোটেই কষ্ট হয় নি যে, অন্তত মিনিট দশ আগেই সূর্যোদয় হয়ে গেছে। কি আর করা যাবে, মনটা খারাপ করেই এগোতে লাগলাম লাল কাঁকড়ার চরের দিকে। এটা চমত্কার। দারুণ অনুভূতি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের অস্তিত্ব বুঝতে পারলেই সারি সারি লাল কাঁকড়া গুলো নিমেষেই সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে। কোনোভাবেই একটা ছবিও তুলতে পারলাম না। মেজাজটা তখন প্রচণ্ড রকমের খারাপ। ঢাকা থেকে হানিফ পরিবহনের ফালতু একটা গাড়িতে এতটা পথ আসা, ঘাটের প্রচণ্ড জ্যাম এবং সবশেষে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় কোনোটাই না পাওয়া। অনেক চেষ্টার পর একটা মাত্র লাল কাঁকড়ার ছবি তুলতে সফল হলাম। এখন মন ভালো।

সমুদ্রের তীর ছেড়ে সীমা বৌদ্ধ মন্দিরের দিকে এগোলাম। সামনেই কয়েকটা হোটেল ছিল, সেখানেই নাশতা করে রাখাইন পল্লী, সম্ভবত গঙ্গামতির জঙ্গল দেখে ফিরে এলাম হোটেলে।

ভাবলাম একটু ঘুমিয়ে আবার বের হবো। আজ মিস হয়েছে ও কি হয়েছে কাল দেখবো। অন্তত দুই দিন থাকবো এবার। কিন্তু বিধি বাম। কিছুক্ষণ পরেই Boss কল দিলেন। কোনো কথা বলার আগেই Boss বলে উঠলেন,” সৈকত, যে অবস্থায় আছো ঠিক ঐ অবস্থায় ফিরে আসো। কাল অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। অনুপস্থিত থাকার কোনো সুযোগ নাই।” প্রাইভেট চাকরি যারা করে তাদের কাছে নিজের বউয়ের থেকেও Boss সম্ভবত বেশিই প্রিয় হয়। আমিও একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো বললাম,”জি, Boss.” ……..

■ একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে দেশের প্রকৃতি এবং পরিবেশ কে নির্মল এবং সতেজ রাখাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাই আসুন, প্রকৃতি এবং পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে প্রকৃতি এবং পরিবেশ কে পরিচ্ছন্ন রাখি।

Source:  সৈকত হোসেইন

Share:

Leave a Comment