ঐতিহ্যের সন্ধানে কিশোরগঞ্জে একদিন

আগের দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া এক্সপ্লোর করে রাতে ভৈরব থেকে বাসে কটিয়াদী চলে আসি। কটিয়াদী বাস স্টপ সংলগ্ন একটি হোটেলে রাতে থেকে ভোরেই বের হয়ে গেলাম কিশোরগঞ্জ এক্সপ্লোরের উদ্দেশ্যে। বরাবরের মতোই এবারও ট্যুরমেট নাদিম।কটিয়াদি বাস স্টেশন থেকে রিজার্ভ নিয়ে নিলাম মোটর চালিত রিকশা। ১৫ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম গোপীনাথ মন্দিরে।সকাল সকাল মন্দির দর্শন শেষে একই রিকশায় করে চলে গেলাম সুকুমার রায়ের বাড়ি অর্থাৎ অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক নিবাস দেখতে।জরাজীর্ণ এই বাড়ি দেখা শেষ হলে একই রিকশায় চলে যাই মশুয়া বাজার।সব মিলিয়ে ভাড়া দিলাম ১৩০ টাকা।মশুয়া বাজার থেকে লোকাল সিএনজি করে জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়ায় চলে এলাম গঞ্জের হাট।সেখানে চিতই পিঠা আর গরম চায়ে ১৫ টাকায় সেরে নিলাম সকালের নাস্তা।উল্লেখ্য,এগারসিন্দুর গ্রামেরই আরেক নাম গঞ্জের হাট।জনশ্রুতি রয়েছে, ১১টি নদীর মোহনায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে উঁচু শক্ত এঁটেল লাল মাটির এলাকা ব্যবসা বাণিজ্য ও বসবাসের স্থান হিসেবে উৎকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ায় গঞ্জের হাট নামে এটি প্রসিদ্ধ ছিল।

হাটটি ১১টি নদীর সংগমস্থলে হওয়ায় স্থানীয়রা ১১টি নদীকে সিন্দু আখ্যায়িত করে গঞ্জের হাট থেকে স্থানটির নামকরণ করেন এগারসিন্দুর।নাস্তা সেরে আবার রিজার্ভ নিয়ে নিয়ে নিলাম একটি মোটর রিকশা।ঐতিহাসিক এই গ্রামে দেখে নিলাম প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন ৪ টি স্থাপনা।প্রথমেই গেলাম অপরূপ কারুকার্য খচিত প্রাচীন মসজিদ শেখ সাদী মসজিদ ও মাহমুদ শাহ মসজিদে।এরপর ঐতিহাসিক এগারসিন্দুর দুর্গস্থলটি (ধ্বংসপ্রাপ্ত) দেখে একই রিকশায় চলে এলাম ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে খননকৃত বেবুদ রাজার দীঘিতে।সুবিশাল দীঘির পাড়ে খানিকক্ষন বিশ্রাম শেষে চলে গেলাম থানার ঘাট বাস স্টপে।রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিলাম ১৫০ টাকা।সেখান থেকে জনপ্রতি ৮০ টাকা ভাড়ায় বাসে করে গিয়ে নামলাম কিশোরগঞ্জ সদরের পুরাতন জেল বাস স্টপে।ইজি বাইকে ৩ মিনিটে চলে গেলাম বেলি ব্রীজ।সেখান থেকে গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইজি বাইকে উঠলাম।ভাঙ্গা রাস্তা ধরে গাঙ্গাটিয়া বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম।১৫ মিনিট পর ড্রাইভার বললেন,জমিদার বাড়ি ডানে কিন্তু উনি সোজা যাবেন তাই এখানে নেমে যেতে হবে।

জনপ্রতি ১৫ টাকা করে ভাড়া চুকিয়ে অগত্যা নেমে পড়লাম।সেখান থেকে রিকশা নিয়ে ১ কিমি. দূরের জমিদার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম অল্প সময়েই।অদ্ভূত সুন্দর জমিদার বাড়িটি দেখে ফিরেও আসলাম একই রিকশায়,ভাড়া ৪০ টাকা।যেখানে ইজিবাইক নামিয়ে দিয়েছিলো,সেখান থেকেই পেয়ে গেলাম ইজিবাইক।এবার সরাসরি চলে গেলাম নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদে।ভাড়া আগের মতই জনপ্রতি ১৫ টাকা।তিনগম্বুজ বিশিষ্ট নান্দনিক মসজিদ দেখে হালকা নাস্তা সেরে নিলাম।এরপর ঘুরে দেখলাম গুরুদয়াল কলেজ,ওয়াচ টাওয়ার(শুক্রবার দুপুরে গেট বন্ধ থাকায় টাওয়ারের উপরে ওঠা হয় নি) ও ঐতিহাসিক শহীদি মসজিদ।এদিকে ঘুরতে ঘুরতে জুমা’র নামাজের সময় হয়ে এলো।দ্রুতই রিকশা নিয়ে ২০ টাকা ভাড়ায় চলে গেলাম দেশের বৃহত্তম ঈদগাহ শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে।ঈদগাহ মসজিদে জুমা’র নামাজ আদায়ের ইচ্ছা থাকলেও সেখানে গিয়ে দেখি ঈদগাহ মসজিদে জুমা’ পড়ানো হয় না।পরে পাশের আরেকটি জুমা’ আদায় করি।এরপর সোলাকিয়া মাঠের সামনে থেকে রিকশা নিয়ে চলে গেলাম বৌলাই জমিদার বাড়িতে (স্থানীয় ভাবে এটি সাহেব বাড়ি নামে পরিচিত)।জেনে রাখা ভালো,মহাকাব্য শাহানামা’র বাংলা অনুবাদক মনিরুদ্দিন ইউসুফের বাড়ি এটি।নান্দনিক এই জমিদার বাড়ির পাশেই রয়েছে কারুকার্য খচিত প্রাচীন মসজিদ।রিকশা ভাড়া ৪০ টাকা পরিশোধ করে দুপুরের খাবার পর্ব সেরে নিলাম।

স্থানীয় একটা ঝুপড়ি টাইপ হোটেলে দুইজনে ভরপেট খেয়ে নিলাম মাত্র ১২০ টাকায়।এই টাকায় কিন্তু ২ কাপ চা ও রয়েছে।আবার রিকশা নিলাম,গন্তব্য ইশা খাঁ’র জঙ্গলবাড়ি দুর্গ ও জঙ্গলবাড়ি মসজিদ।২০ মিনিটে পৌছে গেলাম,ভাড়া ৪০ টাকা। ১৫৮৫ সালে রাজা লক্ষন হাজরা ও রাম হাজরাকে পরাজিত করে দুর্গটি দখল করেন ইশা খাঁ।পাশেই নির্মান করেন তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ও খনন করেন সুবিশাল দীঘি।হেটেই চলে গেলাম দেওয়ানগঞ্জ বাজার।সেখান থেকে অটোরিক্সায় অটোরিক্সায় জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়া চলে গেলাম গুজাদিয়া বাজার।এখান থেকে ২০০ টাকায় অটোরিক্সা রিজার্ভ নিয়ে প্রথমে গেলাম বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি ও মন্দির দর্শনে।পরিত্যক্ত এই বাড়িতে এখন বসবাস করেন কয়েকটি গরীব পরিবার।বাড়ির সামনেই সুবিশাল ৩ টি শিব মন্দির স্থাপিত। এখানে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে চলে গেলাম পাশের ইউনিয়ন তালজাঙ্গায় অবস্থিত তালজাঙ্গা জমিদার বাড়িতে।এই বাড়িটিও পরিত্যক্ত,কিন্তু ভবনগুলোর অসাধারণ নির্মাণশৈলী আপনাকে মুগ্ধ করবে।তালজাঙ্গায় ইজিবাইককে বিদায় জানিয়ে জানানোর সময় খেয়াল করলাম দিনের আলো কমতে শুরু করেছে।এখনো বাকি ১ টা লোকেশন।

দ্রুতই সিএনজিতে উঠে জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়ায় চলে গেলাম তাড়াইল।তাড়াইল থেকে ১২০ টাকায় মোটর চালিত রিকশা রিজার্ভ নিয়ে রওনা দিলাম ধলা’র উদ্দেশ্যে।প্রায় আধা ঘন্টা লাগলো ধলা জমিদার বাড়ি পৌঁছাতে। শতবর্ষী বিশালাকার এই জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে ৬টি কারুকার্য খচিত নান্দনিক ভবন।বাড়ির ভেতরের অংশের মাঠে কিছুক্ষন ফুটবল খেলা উপভোগ করে যখন একই রিকশায় তাড়াইল ফিরছিলাম তখন সন্ধ্যা নেমেছিলো।এই এলবামের সর্বশেষ ছবিটা সেই সময় তোলা।কিশোরগঞ্জের সন্ধ্যাটা আমার কাছে দুর্দান্ত লেগেছে।আকাশে মেঘের ঘনঘটা আর সেই সাথে মৃদু শীতল বাতাসে আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ক্লান্ত শরীরটা যেন পাচ্ছিলো অনাবিল প্রশান্তি। ভেবে ভালো লাগছিলো যে ইশা’খাঁর কিশোরগঞ্জের সম্ভাব্য সবগুলো ঐতিহাসিক স্থানে যেতে পেরেছি।তাড়াইল থেকে সিএনজি নিয়ে জনপ্রতি ৬০ টাকা ভাড়ায় চলে গেলাম কিশোরগঞ্জ শহরে।আগেই ‘রেল সেবা’ অ্যাপ দিয়ে টিকেট কেটে রেখেছিলাম।স্টেশনে গিয়ে ১৩০ টাকায় দুজনে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় রইলাম। কিশোরগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম ভাড়া ২৬০ টাকা।মধ্যরাতে যখন ফেনী স্টেশনে নামছিলাম মাথায় তখনো কিশোরগঞ্জ ঘুরছিলো।

সারাদিনে প্রচুর জার্নি করতে হয়েছে আমাদের।এভাবে এক্সপ্লোর করার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনার মানসিক দৃঢ়তা। দিনের পুরোটা সময় সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে সূর্যোদয় থেকেই আপনার জার্নি শুরু করা জরুরী।কটিয়াদী থেকে শুরু করে ফেনী ফেরা পর্যন্ত দুজনের মোট খরচ ছিলো ২৩১০ টাকা অর্থাৎ জনপ্রতি খরচ ১১৫৫ টাকা।
Source: Mohammed Arman‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment