কেওক্রাডং, চিংড়ি ঝর্ণা, বগালেক, কাপ্তই কায়াকিং, রাঙামাটি ঝুলন্ত সেতু এবং পলওয়েল র্পাক প্যাকেজ ভ্রমণ

ঢাকা থেকে রাত ১১ টার বাসে বান্দরবনের যাত্রা শুরু। আমরা ছিলাম ২জন, উদ্দেশ্য ছিল বান্দরবন থেকে কোন গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে আমিয়াখুম ও নাফাখূম। কিন্তু কোন গ্রুপ না পেয়ে বান্দরবন থেকে যাত্রা শুরু করলাম কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে।

ভোর ৬ টায় বান্দরবন পৌছে, নাস্তা করে অটোতে করে রুমা বাসস্ট্যান্ড। বান্দরবনে পৌছে গাইড সাফুল বড়ুয়ার সাথে কথা বলে রাখছিলাম, উনি অন্য গ্রুপের সাথে যুক্ত থাকায়, উনার বড় ভাই বাবুল বড়ুয়াকে আমাদের গাইড করার জন্য বলে রাখেন। রুমা বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল ৮টায় প্রথম ট্রিপে রুমা, ১১.৩০ টায় পৌছে যাই রুমাতে। ভাল ভিউ পাবার জন্য বাসের ইঞ্জিন কাভারে বসছিলাম, ভিউ ভালই পেয়েছিলাম কিন্তু রোদটাও পুরো মুখের উপর পড়তেছিল।

রুমা বাজার থেকে বাবুল দা আমাদের গাইড করা শুরু করেন। বাবুল দা এখানকার সবচেয়ে সিনিয়র গাইড, অসাধারন মানুষ, আমাদেরকে অনেক হেল্প করেছেন, উনি খুব ভাল একজন মানুষ। দ্রুত সব ফর্মালিটিস শেষ করে, অন্য গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে দুপুর ১২.৪০ এ চান্দের গাড়িতে করে চলে যাই বগালেকে। বগালেকে দুপুরের খাবার খেয়ে ২টায় হাটা শুরু করি কেওক্রাডং এর পথে। ৫.৩০ এর পর কেওক্রাডং এ আর এন্ট্রি হয়না, তাই আমরা খুব দ্রুত হাটা শুরু করি।

কেওক্রাডাং যাওয়ার পথের প্রতিটা মুহুর্ত আপনার সৌন্দর্য্য আর স্বপ্নের হাতছানি দিবে। বগালেক থেকে ৩০ মিনিট পরে চিড়িং ঝর্ণা, তবে আমরা যাবার সময় ৩টা স্থানে যাত্রা-বিরতি দেই, মোট যাত্রা-বিরতি দেই ৪০ মিনিট। ২.৫০ মিনিটের মধ্যেই আমরা ১৩ কিলোমিটার পাহাড়ি উঁচু নিচু ভয়ানক খাড়া রোমাঞ্চকর সুন্দর পথ পায়ে হেটে অতিক্রম করে জয় করলাম বাংলাদেশের ৩য় সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ “কেওক্রাডং“। উঠেই আগে এক বালতি পানি ৫০ টাকায় কিনে গোসল করি ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য হেলিপ্যাড-এ যাই। তখন কেওক্রাডং এর চূড়ায় ভারী মেঘ এসে ঘিরে ফেলছে, সাথে প্রচুর ঠান্ডা।

রাতে খেয়ে দেয়ে সকালে ৫.৩০টায় এলার্ম দিয়ে রাখি যে সকালে সূর্যদয় দেখবো, সকালে এলার্ম বাজতেই বাইরে বের হয়ে দেখি চারদিক মেঘাচ্ছন্ন, মনমুগ্ধকর সেই দৃশ্য, যা ছবি তুলে, ভিডিও করে বা লিখে প্রকাশ করা যাবে না। যতদূর চোখ যায় শুধু মেঘ আর মেঘ। এখানে না আসলে বুঝাই যাবে না, আমাদের দেশটা এতো সুন্দর।

কিছুক্ষণ ছবি তুলে তারপর সকালের নাস্তা করে ৮টায় আমরা কেওক্রাডং চেকআউট করে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন ক্যাম্প কমান্ডার বলল, ১টা ১০ জনের গ্রুপ আছে যারা গাইড ছাড়াই থানচি হয়ে, জাদিপাই ঘুরে কেওক্রাডং এসেছে। আমরা ২জনে একটা গাইড নিয়ে আসছিলাম, এখন তারা আমাদের সাথে এ্যাড হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই তাদের সাথে এ্যাড হয়ে ৯.৩০ টায় কেওক্রাডং থেকে বগালেক এর উদ্দ্যেশে নামা শুরু করি। আমরা ২ জন যেহেতু আগের দিন তেমন ছবি তুলিনি, তাই নামার সময় আমরা বেশি সময় নিয়েছি।

নামার সময় অপরূপ সুন্দরী চিংড়ি ঝর্ণার গোসল করি। পাহাড়ি পথের ক্লান্তি দূর করার জন্যই বোধহয় সৃষ্টিকর্তা এই অপরুপ ঝর্ণা সৃষ্টি করেছেন। ঝিরিপথ ধরে পাহাড়ের মধ্যদিয়ে পিচ্ছিল পাথর পাড়ি দিয়ে মূল ঝর্ণার দেখা মিলবে।

দুপুর ১টায় বগালেক পৌছে যাই, এই স্থান থেকেই দেখতে পাওয়া যায় আকাশ, পাহাড় আর অপরুপ সুন্দর জলের মিতালী। বগালেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১০৭৩ ফুট, গভীরতা ১১৫ ফুট যা একটা ১১ তলা বিল্ডিং এর সমান। বগালেকে গোসল করে ঐ ১০ জনের সাথে এ্যাড হয়ে চান্দের গাড়ি বান্দরবন পযর্ন্ত রির্জাব করে ২ টায় রওনা হই।

রুমা বাজার ৩টার মধ্যে চলে এসে আর্মি ক্যাম্পে রির্পোট করি। আমরা দুজন চেক আউট করতে পারলে ও ঐ ১০ জনের গ্রুপকে তারা ছাড়লো না, ওদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমাদের ৩.৩৫ বেজে যায়। তখন কমান্ডার স্যার আমাদেরকে বলল, ওদের জন্য না থেকে আপনারা চলে যান। বাস-স্ট্যান্ড এ যেয়ে দেখি বাস ৩.৩০ এই ছেড়ে দিয়েছে। তখন গাইড দা আমাদের জন্য একটা হোন্ডা ব্যবস্থা করে দিলেন, ঐ হোন্ডা ১০ মিনিটে আমাদেরকে ঐ বাসে উঠিয়ে দেয়। এরপর বাসে করে রুমা বাসস্ট্যান্ড-এ পৌছাই সন্ধ্যা ৬ টায়। রুমা থেকে ১০ টাকা অটো ভাড়া করে বান্দরবন এসে ৪০০ টাকায় হোটেল হিল র্বাড-এ উঠি। রাতে ঐ ১০ জনের গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করি, তাদেরকে রুমা থেকে আরো ৩/৪টা পয়েন্টে নিয়ে যেয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে অকথ্য কথাবার্তা বলে, আর ৫.৩০ টার দিকে তাদেরকে ছেড়ে দেয়।

পরের দিন ভোর ৫.৩০টায় উঠে ৬টায় হোটেল চেক-আউট করে যাই রাঙামাটির উদ্দেশ্যে। বান্দরবন থেকে রিক্সায় করে রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ড, এখান থেকেই রাঙামাটির বাস ছাড়ে। তবে ঐদিন বাস ধর্মঘট থাকার কারনে আমাদেরকে ভেঙে ভেঙে যেতে হয়।

রোয়াংছড়ি থেকে সকালের নাস্তা করে আবার বান্দরবন ব্রিজের ওখানে ব্যাক করি। এখান থেকে অটোতে ৭ টা বাজে রওনা হয়ে ৮ টায় পৌছাই বাঙালহালিয়া, এখান থেকে আবার অটোতে করে ফেরিঘাট পযর্ন্ত। ২টাকা দিয়ে ফেরি পার হয়ে যাই লিচুবাগানে, লিচুবাগান হতে অটোতে করে যাই কাপ্তাই কায়াকিং ক্লাবে। আমরা কায়াকিং ক্লাবে পৌছাই সকাল ৯.৪৫ এর দিকে। এখানে কায়াকিং করার জন্য ফরম পূরণ করতে হয়, প্রতি ঘন্টা ২০০ টাকা হারে প্রতি বোট ভাড়া দেওয়া হয়। আমাদের দুজনের জন্যই কায়াকিং প্রথমবার, প্রথমে একটু ভয় লাগলেও ধীরে ধীরে ভয়টা কেটে যায়। দুপাশে পাহাড় আর স্বচ্ছ লেকে কায়াকিং করা আসলেই একটা অন্যরকম একটা এক্সপেরিয়েন্স। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে কাপ্তাই লেকে আপনি ভাসছেন সরু একটা বোটে, আবার চাইলেই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারছেন সবুজ পানিকে।

সকাল ১১ টায় কায়াকিং শেষ করে ১১.৩০ রওনা দেই রাঙামাটি ঝুলন্ত সেতুর উদ্দেশ্যে। কায়াকিং সেন্টার থেকে অটোতে করে ২০ মিনিটে পৌছাই কাপ্তাই বাজারে। কাপ্তাই বাজার হতে আবার অটোতে করে আসামবস্তি আসি ১টায়, আসামবস্তি থেকে আবার অটোতে তবলছড়ি। তবলছড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে ৬০টাকায় একটা সিএনজি রির্জাব করে চলে যাই ঝুলন্ত সেতুতে। ২০ টাকা করে টিকেট কেটে ঢুকে পড়ি ঝুলন্ত সেতুতে। ছবিতে যা দেখেছি বাস্তবের ঝুলন্ত সেতু আসলে ততোটা সুন্দর না (আমার ব্যাক্তিগত মত)। তবে ওখানে ৩০ টাকা করে পাহাড়ি আনারস বিক্রি করে, একেবারে পুরোই ফরমালিনমুক্ত, অনেক মিষ্টি। আনারস বিক্রেতা ছেলেটাকে জিগেস করলাম যে এখান হতে ডিসি অফিসে কিভেবে যাবো, সে আমাদের রাস্তা চিনিয়ে দিলো, আর বলল ভাই ডিসি অফিসের সামনে একটা র্পাক আসে “পোলিও র্পাক“ ওখানে ঘুরতে পারেন, অনেক সুন্দর জায়গা।

ঝুলন্ত সেতু হতে বিকাল ৪.৩০টায় বের হয়ে একটা সি.এন.জি রির্জাব করলাম “পোলিও র্পাকে“ যাবার জন্য। আসলে আমাদের হাতে অল্প সময় ছিলো বলে আমরা ডিসি অফিসে না যেয়ে পোলিও র্পাকে যাই। র্পাকের সামনে যেয়ে দেখি যে পার্কের নাম “পলওয়েল র্পাক“, স্থানীয়রা এটাকে পোলিও র্পাক নামেই বলে। পলওয়েল র্পাকের প্রবেশ মূল্য ৩০টাকা। ভিতরে অনেক মনোরম পরিবেশ, এটা ৮/১০টা পার্কের মতো না। এখানে রয়েছে সুইমিংপুল, শিশুদের জন্য খেলনা, লেক সাইড রেস্টুরেন্ট, লেকের পাশেই কটেজ, আর এখনে রয়েছে একটা বড় “লাভ লক“। এখান থেকে লেকের ভিউটা অনেক সুন্দর আসে। এখানে ৫.৩০টা পযর্ন্ত সময় কাটিয়ে ৩০ মিনিটে হেটেই চলে আসি রির্জাব বাজারে। রাতের খাবার খেয়ে রাত ৮টার বাসে করে ঢাকায় ব্যাক করি ভোর ৪টা বাজে।

খরচপাতি (০১ জন) – – –

* ঢাকা – বান্দরবান = ৬২০/- (শ্যামলি বাস)
* বান্দরবান – রুমা বাসস্ট্যান্ড = ১০/- (অটো)
* রুমা বাসস্ট্যান্ড – রুমা = ১১০/- (বাস)

* রুমায় ফরম বাবদ খরচ = ১৪০/-
* রুমা – বগালেক = ৫০০/৩ = ১৬৬/- (চান্দের গাড়িতে শেয়ারিং, গাইডসহ ৩জন)

* কেওক্রাডং-এ গোসল = ৫০/-
* কেওক্রাডং রুম = ২০০/-

* বগালেক – রুমা = ৩০০/৩ = ১০০/- (চান্দের গাড়িতে শেয়ারিং, গাইডসহ ৩জন)

* রুমা – হোন্ডায় বাস ধরতে = ১৫০/২ = ৭৫
* রুমা – রুমা বাসস্ট্যান্ড= ১১০/-
* রুমা বাসস্ট্যান্ড – বান্দরবন = ১০/-

* বান্দরবনে রুম = ৪০০/২ = ২০০

* বান্দরবন – রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ড= ৪০/২ = ২০/- (রিক্সা)

* রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ড – বান্দরবন= ১০/-
* বান্দরবন – বাঙালহালিয়া = ১০০/- (অটো)

* বাঙালহালিয়া – ফেরিঘাট = ৩৫/- (অটো)

* লিচুবাগান – কাপ্তাই কায়াকিং ক্লাবঃ ৩০/- (অটো)

* কায়াকিং ক্লাব – কাপ্তাই বাজারঃ ২০/- (অটো)

* কাপ্তাই বাজার – আসামবস্তিঃ ৯০/- (অটো)

* আসামবস্তি – তবলছড়িঃ ১২/- (অটো)

* তবলছড়ি – রাঙামাটি ঝুলন্ত সেতুঃ ৬০/- (সিএনজি রির্জাব)

* রাঙামাটি ঝুলন্ত সেতু – পলওয়েল র্পাকঃ ১৫০/- (সিএনজি রির্জাব)

* রাঙামাটি রির্জাব বাজার – ঢাকাঃ ৬২০/- (এস আলম বাস)

গাইডের খরচ
* র্চাজ ১৮০০ + ৩ বেলা খাবার ৩০০ + কেওক্রাডং থাকা ২০০ + যাওয়া আসা বাবদ ২৬৬ = ২৫৬৬ টাকা
* আমরা ২জনে ১টা গাইড নেই, ফলে গাইড বাবদ আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছে ১৩০০ টাকার মত।

যাতায়াত ও থাকা বাবদ খরচ ২৯৫০ + গাইড বাবদ খরচ ১৩০০ + খাওয়া ও অনান্য খরচ ১২৫০ = মোট ৫৫০০ টাকা

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য –

১. বান্দরবান থেকে রুমার উদ্দেশ্যে প্রথম বাস সকাল ৮টা, বান্দরবান থেকে রুমার উদ্দেশ্যে সর্বশেষ বাস বিকাল ৪টা ও
রুমা থেকে বান্দরবানের দিক সর্বশেষ বাস বিকাল ৩:৩০।
২. রুমা আর্মি চেকপোস্টে বিকাল ৪টা সর্বশেষ এন্ট্রি।
৩. জাতীয় পরিচয়পত্র এর ফটোকপি অবশ্যই নিয়ে যাবেন।
৪. বগালেকে সাঁতার কাটবেন না।
৫. পর্যাপ্ত খাবার পানি ও স্যালাইন রাখুন পাহাড়ে উঠার সময়।
৬. বর্ষাকালে অবশ্যই ভালো গ্রীপের স্যান্ডেল নিয়ে যাবেন।
৭. কেওক্রাডং এ সর্বশেষ এন্ট্রি বিকাল ৫.৩০টায়, তবে ঋতুভেদে পরিবর্তন হতে পারে।
৮. কেওক্রাডং এ থাকার জন্য যোগাযোগ করুন- লালা বম = ০১৮৬০৪৩৬৯৭৩
৯. এখন বগালেক পর্যন্ত জীপে যায়।

বি দ্রঃ আমাদের পরিবেশ আমাদেরই সম্পদ। ময়লা আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে পরিবেশ দূষিত করবেন না।

Share:

Leave a Comment