মন কাঁড়া হিডেন হাউজ

মাঝে মাঝে, কিছু কিছু ব্যাপার হয়না এমন যে, একটা নির্ধারিত বাজেট নিয়ে শপিং এ গেলাম, মেয়েরা কোন শখের শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবী কিনতে। কিন্তু দোকানে গিয়ে আপনার বাজেটের বেশ বাইরের অপূর্ব সুন্দর আর মন কাড়া শাড়ি বা পাঞ্জাবী দেখে চোখ আটকে যায়। যে সেদিক থেকে আর চোখ ফেরানো যায়না। বাজেট অল্প থাকার পরেও কিছুতেই সেই জিনিষটার কথা ভোলা যায়না, চোখে আটকে থাকে সে অদ্ভুত সুন্দর জিনিষের প্রতি। ওটা না পেলে বা এমন সম্ভাবনা থাকলে খুব খুব মন খারাপ হয়ে যায় অজান্তেই। ভীষণ একটা মনমরা অনুভুতি ঘিরে ধরে রাখে।

আমার ঠিক এমনই অনুভুতি হয়েছিল মাত্র এক ঝলক হিডেন হাউজ, এর চারপাশের প্রকৃতি, অন্দরের সাজসজ্জা, ঝকঝকে মেঝে, চকচকে টাইলস, নান্দনিক আসবাব, উন্নত মানের বাথরুম ফিটিংস আর পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা বারান্দা, আর কাছে-দূরে সবুজ-ধূসর পাহাড়ের পরে পাহাড়ের সিড়ি পেরিয়ে প্রায় হাত ছোয়া দূরত্তে হিমালয়ের বরফ মোড়ানো পর্বত মালার হাসি দেখতে পেয়ে।

প্রথম দেখাতেই মনে হল এই হোটেলে আর এই রুমে যদি থাকতে না পারি, তাহলে এই ভ্রমণই বৃথা, এই ট্যুরই হয়ে যাবে অর্থহীন, কোন রকম অর্জন ছাড়া। একটা অজানা মন খারাপের মেঘ যেন আমাকে ঘিরে ধরলো নিমিষেই। মনে মনে বললাম, যা হয় হবে, দরকার হলে ট্যুরের সময়কাল দুই দিন কমিয়ে দেব, দরকার হলে এক বেলা করে কম খাবো, দরকার হলে আর কোথাও যাবোনা। তবুও আমার এই রুমটা চাই। এই রুমটাই! আমি এই রুম ছাড়া আপাতত আর কিছু ভাবতেই পারছিনা।

অথচ আমি কখনোই এমন নই। ভ্রমণে রুম বা থাকার ক্ষেত্রে আমার সব সময়ের সুত্র হল, সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে, যখন আমার পা দুটো আর চলতে পারেনা আর চোখ দুটো কিছুতেই খুলে রাখা যায়না, তখন মোটামুটি পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ আর পরিষ্কার বাথরুমে ফ্রেস হওয়া যাবে এমন হলেই আমি খুসি। রুম বা থাকার যায়গায় বসে বসে পাহাড়, সমুদ্র বা লেক দেখা যেতে হবে, ব্যাক্তিগত ভাবে আমি এই রকম চাইনা। প্রকৃতিকে তার একদম কাছে গিয়ে দেখাই তো ভালো। তার জন্য অতিরিক্ত খরচ করার পক্ষে আমি কখনোই নই। যে কারনেই আমার একার জন্য এক রুমের বাজেট কখনোই ৫০০-৮০০ টাকার বেশি নয়।

কিন্তু এই প্রথম কোন যায়গা, প্রথম কোন হোটেল আর প্রথম কোন রুম, যেটা দেখার পরে আমি আর অন্য কোন রুমে থাকার কথা ভাবতেই পারিনি। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম এই রুমেই আমি থাকবো। এই রুমই আমার চাই। তাতে বাজেট যতই সাধ্যের বাইরেই যাক না কেন। এরপর দাম জিজ্ঞাসা করে আর কয়জন থাকবো সেটা জানার পরে, কিছুটা আসস্থ হলাম যে নাহ থাকা যেতে পারে। তবুও একটু চেষ্টা করলাম আর একটু কমানো যায় কিনা? কিন্তু না, আর কিছুতেই কমাবেনা কারন এই রুমের যে ভাড়া, তার প্রায় অর্ধেক দামে আমাকে দিতে রাজি হয়েছে, সেটাও আমি একা বলে। দুই বা তিনজন হলে এই দামে দিতোনা।

আমি আর দেরি না করে সম্মত হয়ে ঝটপট রুমে ঢুকে গেলাম। আহ, এই প্রথম আমার এমন কোন রুমে থাকা, যে রুমের জন্য মন আমার এতোটা আকুল হয়ে পরেছিল, যে রুমে থাকতে না পারলে পুরো ভ্রমণ হতাশায় ছেয়ে যেত। উফ, কি যে একটা প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল বোঝানো যাবেনা। ব্যাগপত্র রেখে, ধবধবে বিছানায় একটু বিশ্রাম নিয়ে সাইট সিয়িং এ চলে গেলাম। কারন এই রুম আর রুমের সবকিছু, চারপাশ, কাছে দুরের নানা রকমের পাহাড় আর কত রঙিন ঘরবাড়ি দেখা যাবে ফিরে এসে, রাতে, সকালে আর দুপুর অবদি। তাই বেরিয়ে পরলাম।

আবার যখন রুমে ঢুকলাম তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। চারদিকে রাতের আধার নেমেছে। নানা রঙের আলো আলোকিত হয়ে উঠেছে পাহাড়ের পর পাহাড়ের সারি। রুমে ঢুকে, আলো জালিয়ে বাথরুমে ঢুকে আরো ভীষন অবাক হয়ে গেলাম, ওদের সার্ভিসের মানসিকতা দেখে। সাধারনের মধ্যেই অসাধারণ আয়োজন দেখে। বাথরুমে চমৎকার কিছু প্রসাধনী দেখে। রুমের মধ্যে এক কর্নারে রাখা টি-পট, ছোট ছোট প্যাকেটে চা, চিনি,দুধ আর দুটো বর্ণিল মগ দেখে। বাহ, চায়ের আয়োজন রুম ভাড়ার সাথেই। আরো অবাক করা ব্যাপার একটা হলুদ গোলাপ রাখা আছে অন্য দিকের টেবিলে। মনটা এতো এতো ভালো লাগায় ভরে গেল যে অভিভূত হয়ে কিছু সময় চুপ করে বসে ছিলাম সোফায় গা এলিয়ে আর বিছানায় পা তুলে দিয়ে।

একদিকে টি পটে পানি গরম করতে দিলাম আর অন্য দিকে গরম পানির জন্য গিজার ছেড়ে দিলাম ফ্রেস হব একটা চমৎকার গোসল করে। মনের মত করে গোসল করে নিলাম। তারপর রুমটাকে আলো আর আধারির মত করে বেড সাইড লাইট জালিয়ে দিয়ে চায়ের মগে গরম পানি আর টি ব্যাগ ডুবিয়ে দিয়ে ধবধবে সাদা বিছানার মধ্যে সাদা লেপের তলায় আধসোয়া হয়ে হালকা শীতের আমেজে ধোয়া ওঠা চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে দুরের চাঁদনী রাতের রুপালি পাহাড়ের অনন্য রুপ উপভোগ করতে লাগলাম।

এই হিডেন হাউজ, তার রুমের অসাধারন সাঁজ, চমৎকার আয়োজন, চারপাশের প্রকৃতি সবকিছু মিলে একটা অনন্য সুন্দর, অনন্তকাল মনে রাখার মত সন্ধ্যা উপভোগ করে নিজের চাওয়াকে পুরন করার সুখ সুখ অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম, ওয়েস্ট সিকিমের, আপার পেলিং এর অন্যতম লুকানো আভিজাত্য, হিডেন হাউজের আমার প্রিয় রুমের নরম বিছানায়, কাঁচের জানাল দিয়ে পাহাড়ের সিঁড়ি দিয়ে ছুঁয়ে ফেলা যাবে সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে।

পেলিং এতো এতো পরিচ্ছন্ন একটা পাহাড়ি ছোট্ট শহর যে একে কিছুতেই নোংরা করতে মন চাইবেনা কারোই, কি বলেন?

Source: Sajol Zahid<Travelers of Bangladesh (ToB)

 

Share:

Leave a Comment