অপূর্ব এক সমুদ্র সৈকত কোভালাম ভ্রমণ

কোভালামই এখন পর্যন্ত একমাত্র সমুদ্র সৈকত যা প্রথম দেখাতেই আমার মন কেড়ে নিয়েছে। যদিও, প্রকৃতির সকল কিছুর মাঝে পাহাড় আমার প্রথম পছন্দ। তাই বলে যে শুধু পাহাড়েই যাই এমনটা নয়। পাহাড়ের পাগল করা আহবানের সাথে সাথে, সমুদ্রের মাতলামি, পাগলামিও বেশ ভালো লাগে।অগনিতবার পাহাড়ে যাওয়া হলেও সমুদ্রেও একপবারে কম যাওয়া হয়নি। এখন পর্যন্ত নানা রকম সমুদ্র দেখেছি, আমাদের কক্সবাজার, কুয়াকাটা, চিটাগাং, ভারতের গোয়ার বেশ কয়েকটা সৈকত আর কন্যাকুমারী। আমাদের সেন্ট মারটিনের সাথে কোন কিছুর তুলনা চলবেনা কিছুতেই। শুধু যদি পরিবেশ বাদ দিয়ে প্রকৃতির মুগ্ধতার কথা বলি। এসব নানা রকম সৈকতের নানা রকম রঙ, রুপ দেখে ভালো যে লাগেনি তা নয়। সবসময়ই দারুন লেগেছে।

কিন্তু ওই যে আছেনা, কোন কিছু প্রথমবার দেখেই মুগ্ধ হয়ে যাওয়া, প্রথম দেখাতেই কেউ মন কেড়ে নিতে পারে, পাহাড় বাদ দিলে কোভালামই একমাত্র সমুদ্র সৈকত যা দূর থেকে একটু দেখেই বিস্মিত আর কাছে গিয়ে তাকে সামনা সামনি দেখতেই মন কেড়ে নিয়েছে। যাকে প্রথমবার দেখেই মুগ্ধ নয়নে আর অপলক দৃসটিতে তাকিয়ে ছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল আর কোথাও এক পাও না নড়ে ঠায় দাড়িয়ে শুধু দুচোখ ভরে দেখে যাই আর দেখে যাই।

অথচ সেই উপায় তো নেই, ছিলোনা। সাথে আছে ছেলে আর তার মা। ওদের জন্য হলেও এখন আগে রাতে থাকার জন্য রুম খুজে বের করতে হবে। একা হলে নিশ্চিত, রুম টুম খুঁজে বের না করে, প্রান ভরে উপভোগ করে নিতাম কোভালামের নীল জল, সাদা ঢেউ, রুপালি উচ্ছাস, মাতাল বাতাস আর সারিসারি নারিকেলের অরণ্য। যতক্ষণ শরীরে শক্তি আর মনের জোর থাকতো আর পারতাম চোখ দুটোকে খুলে রাখতে, সাথে ক্ষুধাকে ভুলিয়ে রাখতে ততক্ষন। হ্যা ঠিক ততক্ষন আমি বসে থাকতাম ঠায়, কোভালামের বালুকাবেলায়, সবুজ ঘাসের গালিচায়, হারিয়ে যেতাম ঘন নারিকেলের অরণ্যে, চুপ করে হেলান দিয়ে থাকতাম কোন এক পাহাড়ের কোলে আর চোখ রাখতাম পলকহীন কোভালামের দিগন্ত বিসৃত জলরাশিতে।

কন্যাকুমারী থেকে যখন কোভালাম যাওয়ার জন্য ত্রিভুন্নাপুরাম এর ট্রেনে উঠি, তখনও মনে মনে ভাবনা ছিল এমন যে, ইস আর একটা দিন কন্যাকুমারী থেকে গেলেই বোধয় ভালো করতাম। কোভালাম নাহয় নাই যেতাম। কেমন না কেমন হবে সেই অপরিচিত সৈকত কে যানে? যদি কন্যাকুমারী বা গোয়ার মতই হয়, তাহলে আর গিয়ে কি হবে? নতুন কিছু দেখতে না পেলে তো এদিকে থেকে গেলেই ভালো করতাম।
যদিও, কন্যাকুমারী থেকে ট্রেন ছেড়ে দেবার পরেই আমরা কন্যাকুমারীকে বেমালুন ভুলে গিয়েছিলাম নিজেদেরকে অবাক করেই। কেন ভুলে গিয়েছিলাম ট্রেন ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথেই কন্যাকুমারীকে সেই গল্প নাহয় পরে বলা যাবে।

তো যেটা বলছিলাম… এবার দক্ষিণে যাবার আগে, চেন্নাই, উটি, কন্যাকুমারী নিয়ে যতটুকু গবেষণা করেছি তার একভাগও আমরা কোভালাম নিয়ে করিনি। এমন কি কোভালাম যাবো কি যাবোনা সেটা নিয়েও সন্দিহান ছিলাম। ভেবে রেখেছিলাম সময় পেলে, ইচ্ছে হলে না হয় এক বেলার জন্য গিয়ে ঘুরে আসা যাবে বা যাবার পথে একটু ঢু মারা যাবে। তাই এই সৈকত নিয়ে আমাদের মাঝে অন্য যায়গা গুলোর মত করে আলাদা কোন উচ্ছাস বা উদ্দীপনা ছিলোনা। যার আর একটা অন্যতম কারন বোধয় কোভালাম খুব পরিচিত কোন সৈকত নয় আমাদের কাছে।

কন্যাকুমারী থেকে কেরালার রাজধানী আসতে, ট্রেন এর দুই পাশের সবুজের মুগ্ধতা জড়ানো পথ আমাদের সেই যে আকুল করে ফেলেছিল যেটা আর একটু সময়ের জন্যও ফিকে হয়ে যেতে পারেনি এতটুকু সময়ের জন্যও। ত্রিভুন্নাপুরাম স্টেশনে নেমে পাচ মিনিটের মত কোন বাসে যাবো আর কোথায় সেই বাস পাবো এই সাময়িক সমস্যা কাটিয়ে উঠে একটা অটোতে করে কোভালামের বাস স্ট্যান্ডে পৌছে গেলাম ৪০ রুপির বিনিময়ে। অটো থেকে নেমে, এক প্যাকেট চিকেন বিরিয়ানি কিনে নেয়া হল সাময়িক ক্ষুধা মিটিয়ে নেয়ার জন্য। বাকিটা পরে দেখা যাবে।

অটো থেকে নামতেই রাজপথের এক গাছের ছায়ায় দেখি একটা লাল হলুদ রঙের কাচের বিশাল বাস দাড়িয়ে আছে। যে বাসের সামনে আলো জেলে বড় বড় অক্ষরে লেখা ঘুরছে কোভালাম! ব্যাস আর কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই ব্যাগপত্র নিয়ে তিনজনে মিলে উঠে পরলাম। উহ, বাসে উঠেই একটা প্রশান্তিতে মন ভরে গেল। বাসের ভিতরে হিম হিম ঠাণ্ডা এসির বাতাস আর বড় বড় সিটের আয়োজন দেখে।
তিনজনে মনের মত সিট বেছে নিয়ে বসে পড়লাম। আমরা উঠতেই বাস ছেড়ে দিল। আহ, দারুন আরামের সেই বাসে বসেই বিরিয়ানি দিয়ে সাময়িক খাবার খেলাম তিনজনে মিলে। আর তারপর বাসের বিশাল কাঁচের জানালা থেকে দুই পাশের অল্প উঁচুনিচু পথের বাঁকে বাঁকে সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে পথ চলতে লাগলাম।

কি যে আরামের আর মন ছুয়ে যাওয়া ছিল ত্রিভুন্নাপুরাম স্টেশন থেকে কোভালাম যাওয়ার পথটুকু। একদম নীরব, নির্জন, নিরিবিলি। কোন মানুষজন নেই, নেই তেমন কোন ঘরবাড়ি বা দোকান পাট, চোখে পড়েনি তেমন কোন যানবাহন বা শহর। যেন মানুষ, বসতি, দূষণ আর কোলাহলমুক্ত নির্জন পিচ ঢালা আঁকাবাঁকা পথে শুধু আমাদের বাস ছুটে চলেছে। শান্ত একটা পরিবেশ, কোথাও কোন কথা নেই, বাসের কজন যাত্রী সবাই যে যার মত চুপচাপ বসে আছে। শুধুমাত্র আমরা তিনজনই যা কিছুটা খুনসুটি করছিলাম।

প্রায় ২৫ মিনিট এভাবে বাস চলার পরে, একটা পাহাড়ি বাক নিতেই দুরে মনে হল নীল জলের সৈকত দেখা গিয়েছিল এক ঝলক। ঝটপট আবারো চোখকে সেদিকে রাখতেই, আবারো সমুদ্রের নীল নীল জলরাশি যেন ক্ষনিকের জন্য দেখা দিল। যেন সবুজ গাছ আর বিশাল পাহাড়ের মাঝ দিয়ে একটু উঁকি দিয়েই পালিয়ে গেল! তাই এবার আর চোখ না সরিয়ে তাকিয়েই রইলাম, সাথে ছেলে আর তার মাকেও নীল জলের দেখা পাওয়ার কথা বললাম। ওরাও তাকিয়ে রইলো এবার বাসের কাঁচের জানালা দিয়ে।

হ্যা আসলেই তাই, সত্যি সত্যি-ই নীল জলের রাশি রাশি ওই জলরাশি সমুদ্রই ছিল। বাস যখন পাহাড় পেরিয়ে প্রায় সমুদ্রের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। সমুদ্র দেখা না গেলেও সারি সারি নারিকেল গাছের পাতার মাতাল ওড়াউড়ি দেখে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এসব দেখে একটু বুঝে ওঠার আগেই হুট করে বাস থেমে গেল। সবাই নেমে পড়ছে। আমাদেরকেও নামতে হবে। চলে এসেছি। বাসের কনডাক্টর জানালো। চল তাহলে, সবাই মিলে ব্যাগপত্র নিয়ে নেমে পরলাম।
Source: Sajol Zahid‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment