একদম কম বাজেটে আগারতলা ত্রিপুরা ভ্রমণ

একটা সময় ছিলো যখন একা একাই ঘুরতে চলে যেতাম। ২০০৮-২০১৫ পর্যন্ত একা একাই ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য, ভুটান,নেপাল এবং নিজ মাতৃভূমির বিভিন্ন জেলা একা একা ঘুরে বেড়াতাম। এরপর ২০১৬ থেকে গ্রুপ করে ঘুরা শুরু। দীর্ঘবিরতীর পর আবারো আজ একা বের হলাম। এবারের গন্তব্য ছিলো আগারতলা ত্রিপুরা। আগে থেকেই প্লান ছিলো একদম কম বাজেটে ঘুরে আসার।

তো প্লান অনুযায়ী ১৭ আগস্ট বাসা থেকে বের হয়ে কমলাপুর চলে আসি। ২ মিনিট জন্য পারাবত ট্রেন মিস করি। চোখের সামনে দিয়ে প্লাটফর্ম দিয়ে ৬:৩৫ চলে গেল।
কি আর করার, এরপর মহানগর গৌধুলির জন্য ৭:৪৫ পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম,এর ফাকে নাস্তাটা ও করে নিলাম।৭:৩৫ এ সিট ছাড়া ট্রেনের টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পরলাম। ভৈরব পযন্ত বসেই গেছিলাম। এরপর আর সুখ সয় নাই ভৈরব থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ছিলো ট্রেনে মারাত্মক ভীর আর ঠেলাঠেলি,দাড়িয়ে থাকাটাই অনেক কষ্টকর হয়েছিলো।

যাইহোক ১১ টা নাগাদ আখাউড়া নেমে একটা রিকশা নিয়ে সোজা চলে যাই বর্ডারে। বর্ডারে ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিয়ে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন গেলাম গিয়ে দেখি এটাতো একটা ছোটখাটো পুরানো ভূতের বাসা। মোটামুটি মাঝারি সাইজের একটা রুম। তিনটা ডেক্স,সিলিং ফ্যান নাই,স্টান্ড ফ্যান ছিলো কয়েকটা,এসি আসে তবে চলেনা।যাইহোক ৩০ মিনিট ইমিগ্রেশন শেষ করে ইন্ডিয়া ইমিগ্রেশন পা দিয়ে তো পুরা হতভম্ব ! রীতিমতো একটা ফুটবল মাঠ।অনেক জায়গা নিয়ে পরিস্কার সাজানো গোছানো সুন্দর একটা অফিস।এখানে ও ২০ মিনিটে কাজ হয়ে গেলো।

এরপর এইপারে এসে বাংলা টাকা ২৫০০ ভাংগিয়ে ২০০০ রুপি পাই। তারপর একটা রিকশা নিয়ে চলে যাই কাশারিপ্পট্টি ৪০ রুপি দিয়ে। রিকশা থেকে নেমেই খাবারের হোটেল খুজতে থাকি,আশেপাশে যেগুলো চোখে পরে সেগুলার ভিতরের পরিবেশ দেখে খাইতে ইচ্ছে হয়না আর।পরে কয়েকজন কে জিজ্ঞাসা করে একটা ভালো খাবার হোটেলে সন্ধান পাই হোটেল আদর্শ. মোটামুটি ভালো পরিস্কার, এই হোটেলে শুধু তরকারি নিলে ভাত ডাল সব ফ্রী।আমি মাছ নিলাম ১৪০ টাকা দিয়ে। খাবারের পর আবার কাশারিপট্টি চলে গেলাম সেখানে একটা মসজিদ আসে,ওই মসজিসে জোহরের কসর দু রাকাত নামাজ পরে ৩০ মিনিট রেষ্ট নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম শহর টা দেখার জন্য।এর মাঝে ৪০০ রুপির শপিং ও করে নিলাম।

আসলে আগারতলা শহরে দেখার মত একটা জিনিস ই আসে তা হলো উজ্জয়ন্ত রাজপ্রাসাদ,এইছাড়া আর যা আছে তা উল্লেখযোগ্য নয়।
১৯০১ লন্ডনের মিসেন মার্টিন বার্ন কোম্পানি ৮ শ একর জায়গা জুড়ে নির্মাণ করেন অনিন্দ্য সুন্দর এই প্রাসাদ। কাশারিপট্টি থেকে ৮/১০ মিনিট হাঁটলেই পেয়ে যাবেন এই প্রাসাদ। প্রাসাদে প্রবেশ ফী ২০ রুপি,ফরেনারদের জন্য ১৫০ রুপি। আমি ১৫০ রুপি দিয়ে প্রবেশ করলাম।যাইহোক পুরো প্রাসাদ ঘুরতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগলো। প্রাসাদে ভিতরে সেভেন সিষ্টারের ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছু ও বাংলাদেশের সাধীনতার অনেক দুর্লভ কালেকশন আসে। ভালোই লাগছে আমার কাছে।

এরপর বের হয়ে একটু হেটে একটা অটোতে করে ১০ রুপিতে ভাড়ায় চলে গেলাম নাগেরজোলা বাস স্টান্ড।সেখানে থেকে মেলাঘরের বাসে উঠলাম।
ভাড়া ছিলো ৩৫ রুপি,১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটে পৌছে যাই মেলাঘরে।মেলাঘর আসতে আসতে সন্ধা হয়ে গেছিলো।এসে প্রথম কাজ ছিলো হোটেল খুজে বের করা।কিন্তু এসে দেখি মেলাঘর আসেই মাত্র দুইটা আবাসিক হোটেল তাও আবার রুম খালি নাই।খুব চিন্তায় পরে গেলাম! এখন আবার আগারতলা যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ই নেই। প্লান ই ছিলো মেলাঘর থেকে সকালে নীরমহল দেখে আগারতলা যাবো। যেহেতু পরদিন দেশে ব্যাক করতে হবে।পরে কিছু দোকানদার কে জিজ্ঞাসা করলাম থাকার আর কোনো ব্যবস্থা আসে কিনা? তারা বললো নাই। পরে যখন আশা ছেড়ে ই দিলাম তখনই মনে পরলো নীরমহলে পাশেই সরকারি বাংলো আসে।যেটা আগেই থেকেই বুকিং দিয়ে আসতে হয়,তা না হইলে নাকি রুম পাওয়া যাইনা।

ভাবলাম যা থাকে কপালে গিয়ে দেখি একবার।
কিন্ত ওই দিকে রাত হয়ে যাওয়াতে কোনো রিকশা অটো যেতে চাচ্ছেনা! যায়গাটা খুব নির্জন আর প্রায় ১.৫ কিলো হবে। পরে আর কোনো উপাই না দেখে
একা একাই হাটা ধরলাম।রাস্তাটা একদম নীরব ছিলো,কিছুটা ভয় ও কাজ করতেছিলো।

একা একা অচেনা জায়গা কি হয় কে জানে!
তবে টেনশন কম ছিলো কারণ পকেটে আসে ই ইন্ডিয়ান মাত্র ১২০০ রুপি মাত্র।২০ মিনিট হাটার পর ই চোখে পরলো রুদ্র সাগর নামে একটি লেকের ঠিক মাঝখানে রূপকথার রাজপ্রাসাদের মতো আলোকসজ্জায় দাঁড়িয়ে আছে নীরমহল।আকাশে তারাগুলো আজ সব জেগে আসে কেমন যেন এক অদ্ভুত সুন্দর লাগতেছিলো পুরো পরিবেশটাকে।

নীরমহল যে নদীর মাঝে অবস্থিত ওই নদীর এক তীরে সাগরমহল নামে একটা সাজানো গোছানো চারতলা করে দুটো সরকার দালান আছে। একটাতে জিজ্ঞাস করলাম ভাড়া চাইল। ১২০০ 🙁 বললাম আমার বাজেট কম, এর চাইতে কমে হবে কিনা।পরে আরেকে দালানে নিচতলার এক বিশাল রুম দিলো ৫৫০ রুপিতে। রুমটা বেশ বড়সড় ৩ জন অনায়াসে থাকতে পারবে। রুমে উঠে গোসল করার অনুভব করলাম পেঠে খিদাই আগুন জলতেছে ! পাশেই হোটেলের রেস্টুরেন্ট দেখলাম খাবারের দাম আমার নাগালের বাইরে। পরে আবার হাটা ধরলাম মেলাঘরের দিকে … বাজারে এসে দেখলাম খাবার হোটেল প্রায় সব বন্ধ। কিছু বেকারি আর মিষ্টির দোকান খোলা আসে। মিষ্টির দোকান থেকে ৫/ ৬ পদের মিষ্টি খেয়ে আর বড় একটা পাউরুটি ও২ ডজন কলা নিয়ে হোটেলে দিকে চললাম।রুমে এসে অর্ধেক পাউরুটি আর ১২টা কলা খেয়ে ১০:৩০ ঘুমিয়ে পরলাম,একঘুমে সকালে ৮টা। কতবছর পর যে এমন লম্বা ঘুম দিছি মনে নাই।

১৮ আগস্ট সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে বের হলাম নীরমহল দেখতে,টিকিট নরমালি সবার জন্য ই ৩০ টাকা তবে শর্ত হলো ২০ জন না হলে তারা ট্রলার ছাড়বেনা,অন্যথায় রিজার্ভ নিতে হব.একা নিলে ২৭০ রুপি আর ৫/৬/৭ রিজার্ভ নিলে ৬০০ রুপি।
নীরমহল টা হলো লেকের মাঝেই তাই ট্রলারে যেতে হয়,কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ৪ জনের একটা গ্রুপ আসলে তাদের সাথে শেয়ারে ১০০ রুপি দিয়ে চলে যাই। মহলে ঢুকতে আবার ৩০ রুপি প্রবেশ ফী।ও হা আরেকটা কথা এখানে আবার কোন পর্যটক ৪০ মিনিটের বেশি অবস্থান করতে পারবেনা , করলে এক ঘন্টা হিসাবে ১৫০ রুপি দিতে হবে। ট্রলার নেমে ভিতরে ঢুকলাম ৩০ রুপি দিয়ে।

এইপ্রাসাদটি ভারতের সবচেয়ে বড় এবং পূর্ব ভারতে
একমাত্র। ভারতে শুধু দুটি জল প্রাসাদ আছে অন্য আরেকটি রাজস্থান রাজ্যের জাল মহল.পুরো মহলটা ঘুরে দেখে উপরে উঠে ছবি তোলে বেড়িয়ে পরলাম যথাসময়ে।
এরপর হোটেল থেকে ব্যাগ নিয়ে এসে হেটেই মেলাঘর বাসস্টান্ড আসলাম। এখান থেকে ও ৩৫ রুপি দিয়ে আগারতলা নাগেরজোলা আসলাম।
আগারতলা এসে দেখি ১:৫০ বাজে। চিন্তা করলাম এত আগে দেশে গিয়ে কি করবো! বিকালের দিকে যাই আর এই সময় একটা মুভি ও দেখি নি।

সাধারণত আমি ইন্ডিয়াতে আসলে প্রতিবারেই একটা মুভি হলে ও দেখি। পরে প্রথমে গেলাম বিগ বাজারে, গিয়ে শুনি টিকিট প্রাইজ ২৫০ থেকে শুরু! পকেটে যে টাকা আসে তাতে এই টাকা দিয়ে মুভি দেখা যাবেনা। পরে গেলাম আগারতলা সিটি সেন্টারে এখানে ১৫০ রুপি দিয়ে মিশন মংগল মুভিটা দেখলাম। ভালোই ছিল মুভিটা হাউস ফুল ছিলো। মুভি দেখে বের হলাম ৫:১০।

বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে ৫০ রুপি দিয়ে বর্ডার। ইমিগ্রেশন শেষ করে বাংলাদেশে আসতে আসতে ৬:৩০ বেজে গেলো। ইচ্ছে ছিলো মহানগর গৌধুলী ধরার। ৭ টা বাজে আখাউড়া স্টেশনে আসে। কিন্তু প্লাটফর্মে ঢুকার এক মিনিট আগে ট্রেন চলে গেছে 😥 কপাল টা এমন কেন জানিনা! আমার সাথে প্রায় এমন হয়! দেখা যাবে ট্রেন ছাড়ার ৩০ সেকেন্ড অথবা একমিনিট আগে আসি অথবা ট্রেন চলে যাবার 😁। আর যেদিন টাইমমত আসি ওইদিন ট্রেন আর ছাড়েনা😑।

পরে স্টেশন থেকে বের হয়ে শেষ ভরসা আজমপুর স্টেশন থেকে পারাবত ট্রেনটা ধরার। দু’একজন কে
জিজ্ঞাসা করে লোকাল সি এন জি তে করে চলে গেলাম আজমপুর স্টেশন এখানে পারাবত আসার কথা ৮ টা বাজে। সেই ট্রেন লেট করে আসতে আসতে ৯:১৫। যাইহোক ১৬৫ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে উঠলাম,কিন্তু সিট পাইলাম না ঢাকা পর্যন্ত দরজার পাশে বসে দাড়িয়ে ঢাকাই আসলাম। ১২:৫০ আলহামদুলিল্লাহ বাসায় আসলাম।
এই হলো আমার দুদিনের ট্যুরের ইতিহাস।

নিচে একটা হিসাব দেয়া হলো খরচপাতির।

ঢাকা টু আখাউড়া:১৬০
আখাউড়া টু বর্ডার : টাকা লাগেনাই আমার.
ট্রাভেল ট্যক্সঃ৫১০ টাকা।
বর্ডার টু কাশারিপট্টি: ৪০ রুপি
লাঞ্চঃ ১৪০: রুপি
ঊজ্জয়ন্ত প্রাসাদের টিকিট :১৫০রুপি।
প্রাসাদ টু নাগেরজোলা বাস স্টান্ডঃ ১০ রুপি
নাগেরজোলা টু মেলাঘর : ৩৫ রুপি।
ডিনার :৬০ রুপি।
রাত্রীবাস :৫৫০ রুপি।
নীরমহল :১৩০ রুপি।
নাস্তা : ৬০ রুপি।
মেলাঘর টু নাগেরজোলাঃ ৩৫ রুপি।
লাঞ্চঃ ৪০ রুপি।
মুভি : ১৫০ রুপি।
শপিং : ৪০০ রুপি।
নাগেরজোলা টু বর্ডার :৬০ রুপি
বর্ডার টু আজমপুর : ৬৫ টাকা।
আজমপুর টু ঢাকা : ১৬৫ টাকা।

পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই যেখানে যান দেশের ভাবমূর্তি বজাই রাখুন। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না। নিজে সচেতন হন অপরকে সচেতন করুন।
Source: Fayez Ahmed Aazif‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment