মেঘ-পাহাড়-হ্রদের দেশে একদিন

শত শত ছোট বড় পাহাড় আর বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ এভারেস্টকে বুকে ধারণ করে আছে উত্তরের দেশ নেপাল। পাহাড়, জলরাশি আর নাগরিক জীবন নেপালকে করেছে ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণের জায়গা। প্রতি বছর প্রচুর মানুষ সারাবিশ্ব থেকে নেপাল ঘুরতে আসে, ঘুরে বেড়ায় এখানকার সবচেয়ে সুন্দর সব জায়গায় আর প্রিয়জনদের উপহার দেয় একটি সুন্দর অবকাশ। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি উড়োজাহাজে অন এরাইভাল ভিসায় বা সড়কপথে ভারত দিয়ে ট্রানজিট ভিসার মাধ্যমে নেপাল যাওয়া যায়। খরচও পড়ে সাধ্যের মধ্যে। আমাদের আজকের আয়োজন নেপালের সেসব ভ্রমণস্থান নিয়ে নেপাল ভ্রমণকালে যেখানে অবশ্যই যাওয়া উচিত।

এভারেস্ট বেস ক্যাম্প


এভারেস্ট বেস ক্যাম্প, ছবিঃট্রেকারদের ট্রেক করতে করতে এভারেস্ট জয় করার শখটা হয়েই যায় একসময়। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ট্রেক করতে হয় এভারেস্টে উঠতে আর থামতে হয় বেশ কয়েকটি বেস ক্যাম্পে। এভারেস্ট বেস ক্যাম্প পর্যন্ত অনেকে ট্রেক করে যায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট দেখার জন্য। নেপালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ট্রেক অঞ্চলগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেক। বহু বছরের গৌরব, ঐতিহ্য আর মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী এভারেস্ট বেস ক্যাম্পগুলো নিঃসন্দেহে নেপালের সবচেয়ে অসাধারণ এবং দুর্ধর্ষ স্থান।

লুম্বিনি


লুম্বিনি, ছবিঃ৬২৩ অব্দে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল নেপালের পবিত্রতম স্থান হিসেবে পরিচিত লুম্বিনি বাগানে। গৌতম বুদ্ধের জন্মের পর থেকে লুম্বিনি তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়। লুম্বিনির তীর্থযাত্রীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভারতের রাজা আশোকা বা অশোক। রাজা আশোকা তাঁর স্মৃতি স্বরুপ লুম্বিনিতে স্থাপন করে যান তার স্মৃতিস্মারক পিলার। এখন এই জায়গাটা বৌদ্ধ তীর্থযাত্রা কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হয়। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে পর্যটকদের কাছে নেপালের বেশ আকর্ষণীয় স্থান এটি।

থামেল, কাঠমান্ডু


থামেল, ছবিঃনেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর আশেপাশের এলাকার নাম থামেল। প্রথম বার নেপালে গেলে থামেলে অবশ্যই যাওয়া উচিত। প্রায় সকল ধরনের ট্রেক সরঞ্জামাদি থেকে শুরু করে ট্রেকের জন্য অনুমতি সবই পাওয়া যায় থামেলে। নেপালে একটি পরিচ্ছন্ন শহরে কয়েকদিন আরামে কাটিয়ে আসতে চাইলে থামেলের বিকল্প নেই। হাঁটা দূরত্বেই দেখা যাবে কাঠমান্ডুর দর্শনীয় দরবার স্কয়ার, বৌদ্ধনাথ মন্দির, গার্ডেন অফ ড্রিমস আর প্রচুর বৌদ্ধ আশ্রম।

পোখারা

পোখারা, ছবিঃ nepaltour.info

থামেল থেকে প্রায় ৭-৮ ঘন্টার পথ পোখারা। নেপাল বিখ্যাত ফেওয়া লেকের তীরে গড়ে ওঠা এই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শহরে আছে ঘুরে দেখার মতো প্রচুর জায়গা। অন্নপূর্ণা সার্কিটের প্রবেশপথ এই পোখারা শহর। ফেওয়া লেকই পোখারার মূল আকর্ষণ। ফেওয়া লেকের তীরে ছোট দ্বীপের উপর রয়েছে তাল বারাহি মন্দির, পূর্ব দিকে রয়েছে যোগ ব্যায়াম কেন্দ্র আর প্রচুর হোটেল। ফেওয়া লেকের পাড়ে নিরিবিলি একটা সন্ধ্যা কাটাতে, কায়াকিং করতে আর লেকের উপর ছোট ছোট উড়োজাহাজে করে ঘুরে বেড়াতে এখানে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক আসেন।

সারাংকোট


সারাংকোট থেকে এভারেস্ট দেখা, ছবিঃপোখারা থেকে পশ্চিমে একটু দূরেই প্রায় ১,৬০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত সারাংকোট গ্রাম। নেপালের গান্ধাকি অঞ্চলে অবস্থিত এই গ্রাম থেকে উপভোগ করা যায় নেপালের পার্বত্য সৌন্দর্য। সারাংকোট থেকে হিমালয়ের পুরো দৃশ্য ধরা পড়ে চোখের দৃষ্টি সীমানায়। এখান থেকে ফেওয়া লেক সহ দেখা যায় ধৌলাগিরি, অন্নপূর্ণা আর মানালসুর মতো নেপালের কিছু বিখ্যাত পর্বত পরিবার।

নাগরকোট


সূর্যোদয়ে নাগরকোট, ছবিঃ২,১৯৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত নাগরকোট গ্রাম কোন প্রশ্ন ব্যাতিরেকে জায়গা করে নেয় পর্যটকদের নেপাল ভ্রমণ স্থান তালিকার শীর্ষদিকে। বাগমাটি অঞ্চলের ভক্তপুর জেলায় অবস্থিত এই গ্রাম কাঠমান্ডু থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। নাগরকোট থেকে দেখা মেলে উত্তর-পূর্ব মাউন্ট এভারেস্ট আর হিমালয়ান রেঞ্জের পূর্বদিকের পর্বতমালার। নেপালের নৈসর্গিক পর্বত সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে, কাছ থেকে এভারেস্ট দেখতে চাইলে নাগরকোট একটি ভালো বিকল্প।

তিলিচো লেক

তিলিচো লেক, ছবিঃ upload.wikimedia.org

নেপালের লোকালয় থেকে একটু দূরে তথাকথিত সব পর্যটনস্থানকে এড়িয়ে আরেকটু ভেতরের দিকে গেলে পাওয়া যায় নেপালের আসল সৌন্দর্য। তেমনি এক জায়গা নেপালের মানাং জেলা। প্রায় পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত অন্নপূর্ণা রেঞ্জ দ্বারা ঘেরাও করা এই মানাং জেলা আর কালি গান্ধাকির মাঝখানে থোরঙ লা পাসে যেতে পথে তিলিচো লেক পড়বে। এত উঁচুতে পাহাড়ের কোলে জলসৌন্দর্য উপভোগ করতে ইচ্ছা করবে সবারই, কিন্তু তা জোটে কেবলমাত্র ট্রেকারদের কপালে।

গোসাইকুন্ড লেক


গোসাইকুন্ড হ্রদ, ছবিঃনেপালের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে তীর্থক্ষেত্র। গোসাইকুন্ড হ্রদ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪,৩৬০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই হ্রদের চারপাশই পর্বত দ্বারা ঘেরা। আশেপাশে আরো নয়টি হ্রদের সমন্বয় গোসাইকুন্ড হ্রদকে করেছে পরিপূর্ণ। প্রতি বছর আগস্টে জানাই পূর্ণিমা উপলক্ষে শত শত হিন্দু তীর্থযাত্রীরা এখানে স্নানে আসেন। লেকের ঠিক মধ্যখানে বড় একটি পাথর পানি কম থাকলে দেখা যায় যা স্থানীয়রা ভগবান শিবের অংশরুপে বিবেচনা করে।

রারা লেক


রারা হ্রদ, ছবিঃনেপালের সবচেয়ে বড় আর গভীর হ্রদ রারা হ্রদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৯৯০ মিটার উচ্চতায় জুমলা মুগু জেলায় অবস্থিত এই হ্রদের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে রারা জাতীয় উদ্যান। প্রায় ১০.৮ বর্গকিলোমিটারের এই বিশাল হ্রদে দেখা যায় জীব ও প্রাণের অন্যরকম বৈচিত্র। ১৯৭৬ সালে রারা হ্রদকে সংরক্ষণার্থে রারা জাতীয় উদ্যান গড়ে তোলা হয়।

পাতান (ললিতপুর)

পাতান, ছবিঃ

নেপালের ঐতিহ্য বুঝতে হলে আপনাকে যেতে হবে পাতানে। যেকারো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার জন্য পাতানের সমৃদ্ধ স্থাপত্যশৈলী, কাঠের তৈরি বিশাল সব খোদাই করা ভাস্কর্যই যথেষ্ট। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে নেপাল থেকে হারিয়ে গেছে বহু প্রাচীন অমূল্য সংস্কৃতি। ধারণা করা হয়, সেই ভূমিকম্পের আগে পাতানে প্রায় ১,২০০ ভাস্কর্য ছিল যেগুলোর প্রত্যেকটার গঠনশৈলী ছিল অনন্য, একটার সাথে মিলতো না আরেকটা। কাঠমান্ডু থেকে খুব কাছের এ শহরে নেপালের ঐতিহ্যের স্বাদ নেয়ার সুযোগ কাজে লাগায় নেপালে ঘুরতে আসা অধিকাংশ পর্যটক।

Share:

Leave a Comment