সাফারি পার্ক ভ্রমন এবং টিপস

সাফারি পার্ক ভ্রমন এবং টিপস

——————————–

সাবধানঃ মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি। ঐদিন গেলে বাঘ/সিংহের সাথে সাক্ষাত হবে না।

——————————————————————————-

আমি মূলত আর্মচেয়ার ট্রাভেলার। নিজের খুপড়ি ছেড়ে খুব একটা বের হইনা রাস্তার যানজট-গরম-বাসের পিছনে ছুটাছুটি-ভিতরে ঢুইকা চ্যাপ্টা হওয়া ইত্যাদি কারনে। অলসের ধারি যাকে বলে। বিয়ের পর বউকে নিয়েও কোথাও যাই নি। এইবার ১লা বৈশাখের দিন ঘ্যানঘানানি শুনতে শুনতে ভাবলাম কাছে কোথাও যাই। তাই গেলাম নতুন জিনিস সাফারি পার্ক দেখতে। বের হয়ে পড়লাম আল্লাহর নাম নিয়ে ৬ মাসের পুত্র আরিজ সমেত। সাথে পাশের বাসার ২টা জমজ বাচ্চা।

 

গিয়ে মনে হলো – বাহ্! একটা কামের কাম হইছে! এই রকমের জিনিস যদি সরকার আরো কয়টা বানাইয়া দেয়, তাইলে সুন্দরবনটা মানুষের আত্যাচার থেকে বাঁচে। কি সুন্দর বাঘ দেখা যায় বনের মধ্যে! সিংহ জিরাফ সব আছে। আর মানুষে যত খুশি প্যাকেট বোতল ফালাইয়া যাক কোন সমস্যা নাই। এসি বাসের মধ্যে বসে ঘুরে ঘুরে দেখা যায়। মাইক দিয়ে আবার বলেও দেয় কোনটা কোন প্রানী, কোন দিকে তাকালে দেখা যাবে। যাইতেও কোন কষ্ট নাই। বউ-বাচ্চা (৩ মাসের হইলেও অসুবিধা নাই) সব নিয়া একসাথে যাওয়া যায়। আমি তো রীতিমতো মুগ্ধ! এইবার বুঝতে পারলাম, মানুষে প্লাষ্টিকের খালি বোতল-প্যাকেট ইত্যাদি ফালায় বলে যারা ভ্রমনকারীদের দোষ দেয়, তারা না জেনে দেয়। এই দোষ সম্পূর্ণ সরকারের। সরকার যদি এই রকমের সাফারি পার্ক আর কয়টা কইরা দিত, কে যাইতো ঐসব জায়গায়! সুন্দরবনে গিয়া বাঘ দেখছে কেউ আমি আজও শুনি নাই কারো মুখ থেকে। বেহুদাই কষ্ট করতে ঐখানে যাবে কে যদি এমন আর কয়েকটা সাফারি পার্ক থাকে!

 

সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছি, ভ্রমনে যেত চান, সাফারি পার্ক যান। বউ-বাচ্চা সব সহ। আর যেতে যাতে কোন কষ্ট না হয়, সে জন্য কিছু টিপস শেয়ার করছিঃ

 

১. অবশ্যই একটা করে ছাতা নিয়ে যাবেন পার হেড। আপনাকে প্রথমে মেইন গেইট দিয়ে ঢুকার লাইন দিতে হবে। গেইটে এসে গাড়ি দিয়ে নেমেই মনে করবেন না যে ফট করে ভিতরে ঢুকে যাবেন। ২০০ গজ পিছনে গিয়ে গুতোগুতি করে আগে টিকেট নিতে হবে। প্রতি টিকেট ৫০ টাকা। ৫ বছরের নীচে কারো জন্য কোন টিকেট লাগবে না। টিকেট নিয়ে লাইন ধরে ভিতরে ঢুকতে হবে।

 

২. ভিতরে ঢুকার পরেই মনে করবেন না যে সামনেই বাঘের খাঁচা দেখতে পাবেন। গেট দিয়ে ঢুকে ৫০০ গজের মত গেলে আরেকটা গেইট আছে। ওটার নাম “কোর সাফারি পার্ক”। ঐ গেটের ভিতরে সব বাঘ-ভাল্লুক আছে। ওখানে ঢুকার জন্য আরেকটা লাইন আছে। সেই লাইনে আবার বাঁশ দেয়া। তাই মনে করবেন না যে পড়ে এসে আগে ঢুকে পড়বেন! কোন চান্স নাই। বাঁশের মধ্য দিয়ে লাইন দিয়ে গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। এই গেইটে পাড়া দিলেই দেখবেন টিকেট নিয়ে কয়েকজন দাঁড়ানো। এইখানে আবার টিকেট কাটতে হবে। পার হেড ৫০ টাকা। ৫ বছরের নীচে কারো টিকেট এইখানেও লাগবে না।

 

৩. টিকেট নিয়ে এইবার সামনে তাকেলেই বুঝবেন এতক্ষণ গেইটের বাইরে থেকে আপনি লাইনের লেজটা দেখতে পাচ্ছিলেন। সামনেরটা শরীর সহ মাথা। এইখানেও বাঁশ দেয়া। নো ওভার টেকিং! মিনিমান ঘণ্টা দেড়েক লাইনে দাঁড়ানোর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন। এই লাইনের সামনে একটা করে এসি অথবা নন এসি বাস অথবা একটা ছোট পিকআপ (হাইলাক্স) এসে থামলে সেগুলোতে উঠে পড়তে হবে। বসার সীট পাবেন নিশ্চিত। দাঁড়ানো প্যাসেঞ্জার নেয়া এদের নিষেধ। সার্ভিস ভালো রাখার জন্য।

 

৪. বাসে যদি উঠে থাকেন, সেটা ভরা মাত্রই চলতে শুরু করবে। আর সাথে সাথে একটা মাইক আপনার কানের উপরে বিকট স্বরে স্বাগত জানাবে। যদি সম্ভব হয় এয়ার প্লাগ নিয়ে যাবেন আগে থেকে। নয়ত কানে সামান্য সমস্যা হতে পারে যদি আপনি দৈবক্রমে বাসের পিছনের সীটে পড়ে যান।

 

৫. বাস চলবে আর একটু পর পর থামবে। কানের উপর মাইক আপনাকে সবসময় জানিয়ে দিবে কোন দিকে তাকালে কি দেখা যাবে। “ডানে তাকান – গাছের উপর ভাল্লুক” “বায়ে তাকান – সাদা সিংহ; দেখা শেষ হইছে? এত সুন্দর দেখাই তাও নাকি আপনারা কিছু দেখেন না। খালি ড্রাইভারের দোষ” “কেউ গাড়ির গ্লাস খুলবেন না; নামতে চাইলে বলেন নামাইয়া দিব”।

 

৬. ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে আপনার সাফারি শেষ হবে। আপনি যেখান থেকে উঠেছেন  ঠিক সেখানে নামিয়ে দিবে। নেমে গেট ইত্যাদি পার হয়ে বাইরে চলে আসতে পারবেন। এবার আর লাইন ধরতে হবে না। কোন টিকেটও লাগবে না। ৫ বছরের বেশি বয়স হলেও না।

 

৭. গেট থেকে বের হয়ে ডানদিকে গেলে আরেকটা ঢোকার গেইট আছে। ওটা দিয়ে ঢুকতে টাকা লাগবে না। ভিতরে ঢুকলে নেটের ঘর বানানো আছে। ওখানে ঢুকতে টিকেট লাগবে। ১০ টাকা পার হেড। ৫ বছরের নীচে টাকা লাগবে না। নেটের ঘরে ঢুকলে অনেক সুন্দর সুন্দর পাখি আছে। বড় বড় নীল রঙের পাখি। অনেক কিউট! আপনি এখানে পাখির সাথে ছবি তুলতে পারবেন। কেউ কিছু বলবে না। মাথার উপরেও পাখি। দেখতে ভুলবেন না।

 

৮. ঘর থেকে বের হয়ে সামনে গেলে শিশু পার্ক। এখানে শিশুরা খেলতে পারবে। কোন টাকা লাগবে না।

 

৯. আরেকটু সামনে গেলে আরেকটা নেটের ঘর। ওর ভিতরে প্রজাপতি আছে। বাসা থেকে দুরবীন নিয়ে যাবেন। তাহলে সুন্দর করে দেখতে পারবেন।

 

১০. আরো সামনে গেলে “প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র”। ওখান থেকে মনে হয় প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা যায়। কিন্তু আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারিনি। ওটা দিয়ে ঢোকার গেইট বন্ধ ছিল। টিকেট কাটলে খুলে দিবে এমন কোন সিস্টেমও দেখিনি।

 

১১. পাশেই ক্যাকটাসের ঘর। ওখানে মনে হয় ক্যাকটাস দেখা যায়। আমাদের এনার্জি কম ছিল। তাই উঁকি দিতে পারিনি কাছে গিয়ে। আপনারা অবশ্যই দেখে নেবেন। সামনে কুমিরের খাঁচাও আছে। অবশ্যই দেখবেন। সুন্দরবনেও কিন্তু কুমির দেখতে পারবেন না।

 

১২. এবার গেট দিয়ে বাইরে এসে দেখবেন অনেক বাঘ-ভাল্লুক-হাতি-কুমিরের মুর্তি আছে। ওগুলোর সাথে হেলান দিয়ে অনেক অনেক ছবি তুলতে পারবেন। কেউ কিছু বলবে না। ডানদিকে গেলে মনে হয় আরো কিছু দেখার আছে। অবশ্যই খোঁজ নিবেন।

 

১৩. ঘুরাঘুরি শেষ হলে বাইরে চলে আসবেন সর্বপ্রথমে যেই গেইট দিয়ে ঢুকেছিলেন সেই গেইট দিয়ে।

 

১৪. প্রথমে যে বলেছিলাম ছাতা নিতে মনে আছে? তার কারন ভিতরে অনেক উদ্ভিদ আছে, কিন্তু কোন গাছ নাই। সব গজারি। শুধু কাণ্ড, কোন শাখা-প্রশাখা নাই। তাই কোন ছায়া নাই। যতক্ষণ লাইনে থাকবেন বা ঘুরাঘুরি করবেন কোথাও ছায়া পাবেন না। কাজেই ছাতা নিতে ভুলবেন না। আর সাথে পাটি/মাদুর ইত্যাদি কিছু একটা অবশ্যই নিবেন। আপনি ভিতরে বসার মত অনেক মাটি পাবেন, কিন্তু কোথাও কোন ঘাস পাবেন না – সব বালি। কাজেই অধৈর্য্য/পা ব্যাথা ইত্যাদি জনিত কারনে বসতে চাইলেও বসতে পারবেন না যদি মাদুর না থাকে।

 

১৫. ফ্লাক্সে করে ঠাণ্ডা পানি নিবেন বেশি করে। ভিতরে কোথাও পানি দেখি নাই। লেক আছে, কিন্তু সেগুলো খাওয়ার পানি না।

 

১৬. মেইন রোড থেকে পার্কে ঢুকতে একটা চিপা রাস্তা আছে। ওখানে গুতাগুতি করে সবাইকে ঢুকতে হয়। অনেক জ্যাম হয়। তাই ধৈর্য্য ধরে বসে থাকবেন। ড্রাইভারদের গালাগালি করবেন না। বেশি করে ঠাণ্ডা পানি খাবেন।

 

১৭. গলিতে ঢুকার জায়গা ছেড়ে সামনে চলে গেলে একটা সুন্দর নামের রিসোর্ট+রেস্টুরেন্ট আছে। এখানে ঢুকলে গলার উপরের বাকি অংশ কেটে রেখে দেবে। উর্দ্ধাংশ ফেরত নিয়ে আসতে চাইলে ওটা থেকে আরো ২-৩ কিলো সামনে গেলে আরেকটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে দেখলাম। ভালই মনে হয়েছে। চেক করে দেখতে পারেন। এসিও আছে ওখানে।

 

১৮. আরো কিছু জানতে চাইলে এইখানে মন্তব্য লিখতে পারেন। আমরা যেই পর্যন্ত গেছি আপনার প্রশ্ন তার মধ্যে থাকলে অবশ্যই উত্তর দেব।

 

 

অ.ট. বাসায় এসে আরিজের মাকে বলালাম, দারুন ঘুরাঘুরি হলো। খুব মজা। আগামীকাল চলো চিরিয়াখানা যাই। সবটা ঘুরে দেখতে হবে। কিন্তু সে রাজি না। তার ছেলের নাকি একদিনেই এক কেজি ওজন কমেছে। আর কমাতে রাজি না। তাই আপাতত ২-৩ বছর আর কোন ভ্রমনে যেতে রাজি না। কোন মতেই না!

Share:

Leave a Comment