কংলাক পাহাড় ভ্রমণ বিতান্ত

এখন বঙ্গীয় বর্ষপঞ্জির ভাদ্র মাস। কিতাবি বর্ষা সবে শেষ। তবু বর্ষার রেশ তো বেশ আছে। শরৎ এর ঝকঝকে নীল আকাশ মধ্য দুপুরে চকচকে যে আভা দেয়, নিমিষেই কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে শুরু হয় বারিধারা। ঢাকায় বসে শরৎ এর রূপ আর কতটুকুই বা দেখা যায়।

তাই প্রকৃতির আরো কাছাকাছি যাবার তরে চলে গেলাম কংলাক পাহাড়ের দেশে। যেখানে বিস্তর আকাশ, মেঘপুঞ্জি, সবুজ সজল সমুদ্র মিলেমিশে একাকার। বৈচিত্র্যময়
যা হালের সাজেক ভ্যালি।

শুক্রবার রাতের বাসে করে খাগড়াছড়ির পথে। কুমিল্লায় যাত্রা বিরতি। চা আর রুটি খেয়ে সামান্য পেটপুজা করে নেওয়া হলো। বাস চলছে মহাসড়কে সাঁ সাঁ করে। ফেনির মহিপাল পাড় হয়ে যখন খাগড়াছড়ির নাম না জানা কোন এরিয়াতে ঢুকলাম। শুরু হয়ে গেলো সাপের মতো সর্পিল আঁকাবাঁকা রাস্তা। ড্রাইভারের পাশে বসে পুরো দু’ঘন্টার পথ গল্প আড্ডা গান চলতে থাকলো। ভোরের আলো যখন ফুটলো চারপাশ যেন এক আয়োজনী সকাল। দূরের নাম না জানা কোন পাহাড় থেকে ভেসে আসছে মেঘ, পূর্ব আকাশে হঠাৎ আগুন লেগে গেলো। বাসের সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সূর্যদেব মহাসমারোহে বাংলায় ঢুকলো।

আমরা পৌঁছে গেলাম খাগড়াছড়ির ছোট্ট পাহাড়ি শহরে৷ খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক ভ্যালি যেতে হবে চান্দের গাড়ি করে। চান্দের গাড়িতে প্রায় ৭০ কিলোর মত রাস্তা। এই ৭০ কিলো ভ্রমণ হয়তো আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণের একটি। পথিমধ্যে আর্মি ক্যাম্পের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে গাড়ি ছুটে চলছে সাজেক ভ্যালির পথে।

পাহাড় টিলার এই রাস্তায় কখনো এক টানা উপরে উঠছে আবার অন্য পাহাড়ে যাবার জন্য খাড়া ৪০০-৫০০ ফিট নেমে যাচ্ছে। এমনি করতে করতে আমরা উঠে যাচ্ছি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২২০০ ফিট উপরে। রাস্তার পাশে পাহাড়ি ছোট ছোট পাড়া। এপথে আপনি যা সাইট ভিউ দেখবেন তা কয়েকরাত স্বপ্নে দেখেও বিমোহিত হবেন। এতো সুন্দর এতো সুন্দর। রাস্তার পাশে নাক বোচা ফোকলা দাঁতের পাহাড়ি ছোট্ট শিশুরা হাত নেড়ে আমাকে আপনাকে অভিবাদন জানাবে তাদের ভূবণে।

দুপুর ১২ টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত সাজেক ভ্যালি। মাথার উপরে সূর্য। ভ্যালিতে আসার রাস্তায়ও এতো রৌদ্রদীপ্ত পেয়েছি মাথা পুড়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু ভ্যালির উপরে এক অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা অনুভব করছি। মনে হচ্ছে ন্যাচারাল এয়ার কন্ডিশনার ছেড়ে দিয়েছে। আসলে ওই দূর মিজোরামের পাহাড় থেকে ফালি ফালি মেঘ আমাদের ছেদ করে লুসাই পাহাড়ে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে কটেজ ঠিক করে ফেলেছি। এখানে প্রত্যেকবেলায় খাবারের অর্ডার আগে থেকেই দিতে হবে। না হলে হোটেল বলেন আর রেস্টুরেন্ট বলেন কোথাও খাবার পাওয়া যাবে না। কোনমতে খাবার অর্ডার দিয়ে দিয়ে চলে কমলক ঝর্ণার পথে। মোটামুটি একটা ট্রেক পথ। পথ খুব বেশি না হলেও খাড়া রাস্তা । বেশ সময় ও কষ্ট সাধ্য। গ্রুপের একজন মাঝপথেই ফিরে এলো যেতে পারবে না বলে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা পেয়ে গেলাম অনিন্দ্য সুন্দর কমলক ঝর্ণা। এতো কষ্ট করে মানুষ কেনো ঝর্ণায় আসে, এখানে আসলে তা বুঝা যায়, উপলব্ধি করা যায়। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে ঝর্ণায় পানির গতি তখন প্রবল। ঘন্টাখানেক ঝাপাঝাপি করে ফেরার পথ ধরলাম। পথিমধ্যে আমাদের ছোট্ট গাইড পীযুষ পাহাড়ি বাঙ্গি কেটে দিলো। খুব সুস্বাদু আর রসালো ছিলো। চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে চার টা নাগাদ রুমে এসে কোন মতে ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম সেনাবাহিনীর ক্যান্টিন ‘ সম্প্রীতি ক্যাফে’।

আগে থেকেই অর্ডার করা ভাত সবজি ডিম ভুনা । চমৎকার রেসিপি দুর্দান্ত স্বাদ। ভয়ংকর ক্ষুধা থাকায় প্রায় প্রত্যেকেই অস্বাভাবিক রকমের বেশি ভাত খেলাম। রুমে এসে আধঘন্টার মতো ভাত ঘুম দিয়ে চললাম সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া কংলাক পাড়া। এখানেও খাড়া একটা সরু রাস্তা সোজা চলে গেছে কংলাক পাড়া। প্রচুর ঘাম বিসর্জনের মাধ্যমে আমরা সন্ধ্যের একটু আগে পৌঁছে গেলাম কংলাক পাহাড়ে।

পাহাড়ের কোলে সূর্যদেব অস্তমিত হচ্ছে। পশ্চিমের আকাশে রক্ত আভা। এতো বৈচিত্র্যময় এখানকার পরিবেশ। নিস্তব্ধতার নান্দনিকতায় মন হারিয়ে যেতে চাইবে বারবার।
পূর্বে মিজোরামের দানবের মত করে দাঁড়িয়ে থাকা লুসাই পাহাড় হতে পানসে মেঘেদের ভেলা আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরে। মেঘেরা যখন স্পর্শ করে যায় শরীরে যে এক রকম শিহরণ খেলে যায় এ অনুভূতি আর কোথাও পাওয়া যাবে না।

এতোক্ষণে কংলাক পাহাড়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। চারপাশ ভিজা ভিজা নিস্তব্ধতা। লুসাই মহিলারা এক সাথে বসে গল্প আড্ডা করছে। বাশ দিয়ে বানানো হুক্কায় তামাক টানছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন তারা। আবার ফিরছি সাজেকের মেইন ভ্যালিতে। খাড়া রাস্তাটা নামার মুখেই সাঙি দিদির চায়ের দোকান।
দিদি বাংলা বলাতে যতটা দুর্বল ইংরেজি বলতে ততটা পটু। সাঙির হাতে পরম মমতায় বানানো কমলা চা যখন খাচ্ছি তখন পাহড়ের নাম না পাখির ডাকে আতকে উঠছি। চারপাশের লক্ষকোটি পোকামাকড়ের ডাক যেন ভৈরবী রাগ। দিদি মিস্টি একটা হাসি দিয়ে আমাদের পাঁচজনকে তার দোকানের পেয়ারা গিফট করলো।

রুমে এসে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম শরীর যেন আর চলে না। অনন্ত কাল ব্যাপিয়া যদি এভাবে পড়ে থাকতে পারি তবেই যেন সুখ।
শুয়ে থাকার জন্য তো আর আসিনি। ঘন্টা খানেক গা এলিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম সন্ধ্যারাতের উপত্যকা দেখার জন্য। রেস্টুরেন্ট গুলোতে এতোক্ষণে বার-বি-কিউ এর ধোয়ায় এক অন্যরকম পরিবেশ। সারাদিনের ক্লান্তির শ্রান্তির জন্য চারপাশে খাবার দাবারের নানান পশরা।

শ্রান্তির জন্য চায়ের থেকে উত্তম কিছুই নেই।
মনোমোহিনী দিদির চা খেয়ে আবার যেন পরিতৃপ্ত হলাম। আজ অব্দি যত ট্যুরিস্ট এরিয়া তে ঘুরেছি তার মধ্যে সাজেকের খাবার সেরা।
বার-বি-কিউ খেলাম না ডিনারে। আমাদের পছন্দ ছিলো সাজেকের বিখ্যাত ব্যাম্বো চিকেন। বাশের ভিতরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রান্না করা মুরগী সাথে বসনিয়া রুটি।

সাজেকের হ্যালিপ্যাডে বসে আছি। আমাবস্যা রাতে এসেছিলাম বলে একটু আক্ষেপ হচ্ছিলো। রাতের সৌন্দর্য কি কিছুই দেখতে পাবো না! রাত্রি গভীরে সাজেকের দেখা দিলো আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি । সে এক অপরূপ দৃশ্য। য আকাশের পানে একমনে চেয়ে আছি। যেন আমি মহাজগতের মনোযোগী শিক্ষার্থী। কেউ একজন বলেছিলো সাজেক কাউকে ঠকায় না। আসলেই সত্যি কথা।

রাত্রে ঘন্টা চারেকের মতো ঘুম দিয়ে সুবেহ-সাদিকের আগেই আবার হ্যালিপ্যাডে।
সাজেকের সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত মুহুর্তই হচ্ছে সাজেকের সকাল। মেঘ পাহাড় আকাশ সূর্য। এদের লুকোচুরি চলতে থাকে অনবরত। প্রতি পাঁচ মিনিটে এখানকার পরিবেশ বদলে যায়।
এর সৌন্দর্য, এর অপরূপতা, এর মায়া আমি লিখতে জানি না। তাই আর লিখলামও না এ সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে হলে অবশ্যই যেতে হবে কংলাক পাহাড়ের দেশে।

শুক্রবার এড়িয়ে যাবার কারণে আমাদের পার পার্সন খরচ হয়েছে ২৮৪০ টাকা। তবে এ সিজনে শুক্রবার ছাড়া গেলে ২৬০০ -২৭০০ তেও পসিবল।

দেশটাকে অনেক নোংরা করেছি আমরা।
আর করবেন না। কমলক ঝর্ণা যেখানে অল্প কিছু মানুষ যায় সেখানেও পানির বোতল দেখে এসেছি।
একটু সচেতন হলেই এসব এড়ানো যায়।
** পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।

Source: Mehedi Hasan Raj‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment