কাশ্মির-পৃথিবীর বুকে এক টুকরো সর্গ

এই সময়ে কাশ্মীর যাইয়েন না ভাই, অবস্থা গরম! যাদেরকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম এখন কাশ্মীরের অবস্থা কেমন, ভ্রমনে যাওয়া যাবে কিনা, তাদের সবারই ছিলো এই রকম ভাষ্য। মানুষের নিষিদ্ধ বস্তুতে আকর্ষন বেশি! কাশ্মীরে টুরিস্টদের নিরাপত্তা নিয়ে নেটে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। যতটুকু বুঝলাম কাশ্মীর ভ্রমণকারীদের জন্য নিরাপদ, অনাখাংখিত ঘটনা ছাড়া। সিদ্ধান্ত নিলাম কাশ্মীরেই যাবো। ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে টাইপ সিধান্ত! ধর তক্তা মার পেরেক, কি আছে জীবনে!

বাক্স-পেটরা গুছিয়ে বিমানে উঠলাম। ঢাকা থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে শ্রীনগর। ঢাকার ৩৩ ডিগ্রী থেকে শ্রীনগরের ১২ ডিগ্রী! বিমান থেকেই নেমে গায়ে ঠান্ডা কাঁপুনি দিলো। তার উপর আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বিমান বন্দরের বাইরেই আমাদের গাইড জাভিদ অপেক্ষা করছিলো। গাড়ীতে যেতে যেতেই চারপাশের বাড়িঘরগুলো দেখছিলাম। একটি বাড়ি থেকে অন্য বাড়িটি নির্দিস্ট দুরত্তে বানানো। প্রত্যকটা বাড়ির ছাঁদে টালি বসানো। বিমানবন্দর থেকে আমাদের প্রথমদিন থাকার যায়গা প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। প্রথমদিন থাকার ব্যাবস্থা শ্রীনগরের বিখ্যাত ডাল লেকের মাঝে নৌকায়! নামেই নৌকা, ছোটখাটো একটা জাহাজ বলা চলে। নৌকায় কাঠের সৌখিন কারুকাজ। থাকার জন্য সব রকমের আধুনিক ব্যাবস্থা। পানির ঢেওয়ে মাঝে মাঝে নৌকাও দুলছে। একটু ফ্রেস হয়েই যাত্রা শুরু করলাম মোঘল গার্ডেনের দিকে। উচু পাহাড়ের উপরে বাগানটি। চারিদিকে মেঘের আড়ালে পাহাড়গুলোর লুকোচুরি। চারিদিকে নানা রঙিন ফুলের সমাহার। উপর থেকে নিচের ডাল লেক আর চারপাশের উচু পাহাড়।

তারপরের যাত্রা কাশ্মীরের বিখ্যাত টিউলিপ বাগানে। এখন বসন্ত ওখানে। যেদিকে তাকাই শুধু লাল, হলুদ, সাদা আরো নানা রঙের টিউলিপ। পাহাড়ের পাদদেশে টিউলিপ বাগানটি আপনার চোখকে আটকে রাখবে। সুবিশাল এই বাগানে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল হয়।

একইদিনে ডাল লেকে শিখারা ভ্রমন মানে নৌকায় করে অপুর্ব ডাল লেকে ভাসমান জীবন দর্শন। নৌকাটা পাংশীর মত। ভিতরে বসার আরামদায়ক সোফা। আশেপাশে ভাসমান বাজারে দোকানীরা পশরা সাজিয়ে বসে আছে। সুন্দর, শুধুই সুন্দর! কয়েক লাইনে লিখে কোন কিছুই বোঝানো যাবেনা।

শেষ বিকেলে, সুর্য যখন গোলাপী আভা ছড়িয়ে পাহাড়ের পিছে চলে যাচ্ছে তখন নৌকা ঘরের বারান্দাতে বসে জীবন্ত ডাল লেক দেখা আর সাথে এক কাপ গরম কফি, বাকিটুকু কল্পনা করে নিন। প্রথম দিন এভাবে স্বপ্নের ঘোরেই শেষ হলো।

দ্বিতীয় দিন সোনমার্গ যাত্রা। আবহাওয়া আবেদনময়ী! যাত্রা পথে রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বরফ গলা নদী। রাস্তার দু ধারে বরফের উচু পাহাড়। আহা! কি সুন্দর! মাঝে নাস্তা করার জন্য থামলাম। বরফগলা নদীর পাশে হোটেল, বসার যায়গা পাথুরে নদীর পাশে। কুল কুল করে পানি বয়ে যাচ্ছে পাথরের বুক দিয়ে। নাস্তা কি খাবো, সৌন্দর্জ্য খেয়েই কুল পাচ্ছিলাম না! সোনমার্গে গিয়ে দেখলাম বৃষ্টি। জাভিদ বলল, দিল্লীর ফ্যাশন আর কাশ্মীরের মৌসম, মিনিটে মিনিটে বদলায়! সোনমার্গে বেশি ভিতরে গাড়ি যায়না তাই ঘোড়া ঠিক করতে হলো। জীবনে প্রথম ঘোড়ায় চড়ে নিজেকে বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না ছবির ইলিয়াস কাঞ্চন মনে হলো। রাস্তার দুপাশে সাদা বরফের পাহাড় আর পাহাড়ের নিচে দিয়ে বলছে কুল কুল স্রোতে নদী সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। ঘোড়া থামিয়ে বরফ মাঝ দিয়ে হেটে চললাম কিছুক্ষণ। তাপমাত্রা তখন -১৫। হাত পা জমে আইসক্রিম!

তৃতীয় দিন যাত্রা শুরু করলাম পেহেলগামের দিকে। ভাবলাম যা সুন্দর তাতো শ্রীনগর আর সোনমার্গেই দেখে ফেলেছি, নতুন আর কি দেখার আছে! ভুল, একদম ভুল। যাত্রা পথে চারপাশে আপেল, সরিষা আর আখরোট বাগান। পেহেলগামে পৌঁছে ঘোড়া ঠিক করতে হলো। ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ে যাত্রা। এবার বরফের পাহাড় নয়, সবুজ আর সবুজ। যেখানে দেখি সেখানেই মনে হয় আরে এই জায়গাতেতো অমুক ছবির শুটিং হয়েছিলো। মাঝে যাত্রা বিরতি পাহাড়ের মাঝে ঝর্নার পাশে। ঝর্নার পাথরে একবার বসলে মনে হয় বসেই থাকি, উঠার কি দরকার! রাতে থাকার ব্যাবস্থা পাহাড়ি লেকের পাশে একটি রিসোর্টে। পাশের পাথুরে লেকে পার করে দিলাম সারাটা বিকেল, সন্ধ্যা হলো, মনে চায়না উঠি। পরের দিন পেহেলগামেই থাকলাম।

পঞ্চম দিনে যাত্রা গুলমার্গে, বরফের রাজ্যে। সাদা আর সাদা। স্লেজ ঠিক করলাম। বরফের ভিতর দিয়ে স্লেজ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ছোটবেলার সুপারির খোলে চড়ার কথা মনে পড়লো। আমাদের থাকার ব্যাবস্থা এমন জায়গাতে ছিলো যেখান থেকে জানালা খুললেই চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ।

ষষ্ঠ দিনে আবার শ্রীনগরে দিকে চললাম। জাভিদ কাশ্মীরি শালের দোকানে নিয়ে গেলো। কিছু কেনাকাটা করলাম। পরের দিন সকালে বিদায় দিলাম কাশ্মীরকে।

আমরা যা দেখেছি তার সিকিভাগও এই লেখায় তুলে ধরতে পারিনি। এই সৌন্দর্জ্য ক্যমেরায় ছবির থেকেও সুন্দর। একেকটা স্পট নিয়ে আলাদা করে কয়েক পর্ব লেখা যায়। কাশ্মীরি খাবার, পোশাক, রীতিনীতি নিয়ে তো কিছুই লিখতে পারিনি।

পরিবেশ সচেতনতাঃ কাশ্মীর খুব নিরিবিলি যায়গা। ওখানে পলিথিন নিষিদ্ধ। রাস্তায় কোথাও চিপস বা সিগারেটের প্যাকেট চোখে পড়েনি। প্রতিটি জায়গায় লেখা ছিলো পরিবেশ আপনার, আপনি এর দেখভাল করবেন।

Source: Masud Rana Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment