ঘুরে আসুন নবাবগঞ্জের কালাকোপা

সময়টাই ঘুরাঘুরির। ছেলে-বুড়ো সবাই বেড়িয়ে পড়েছে ঘর ছেড়ে। কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতেই হবে। সবচেয়ে চাপে জনপ্রিয় ভ্রমণস্থল কক্সবাজার আর সাজেক। কিন্তু সবার পক্ষে তো এত দূরে ভ্রমণে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই না? বাচ্চাদের না হয় স্কুল ছুটি, কিন্তু বড়দের তো অফিস, ব্যবসা এসব থেকে ছুটি নেই। বেড়াবেড়ির এই সরগরম মৌসুমে তাহলে কি ঘরে শুধু ফেসবুকে দেখতে হবে অন্যদের আনন্দ ভ্রমণের ছবি?
কিন্তু হুট করে মন চাইলো আর বেড়িয়ে পড়লাম সে অবস্থাও নেই এখন। দূরবর্তী অঞ্চলের বাসের সীট পাওয়া প্রায় অসম্ভব। থাকার জায়গাও মিলবে না এখন আর। সবচেয়ে বড় কথা, যেহেতু এখন সব জায়গাতেই পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় তাই ‘চাহিদা বাড়লে দাম কমে’ অর্থনীতির এই সূত্রকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা হাঁকছে দ্বিগুণ ভাড়া। বিশেষ করে হোটেল রুম, নৌকা আর চাঁদের গাড়ির ভাড়ার ক্ষেত্রে ঘটছে এমন হয়রানির ঘটনা। তাহলে উপায়?
এমন সময়েও মাত্র ৫০০ টাকা নিয়েই একটা ডে ট্রিপে বেরিয়ে পড়তে পারেন আপনি। পরিবার বা বন্ধুদের সাথে নিলে এই খরচ গড়ে জনপ্রতি আরও কমে আসবে। ঘুরে আসুন নবাবগঞ্জের কালাকোপা থেকে। নদীর হিমশীতল বাতাস আর ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন সব স্থাপনা এই দুই মিলে আপনার চোখ যেমন পাবে প্রকৃতির কাছে যাওয়ার শান্তি তেমনি পাবে ইতিহাসের সান্নিধ্য।
মূলত দোহারের একটি গ্রাম এই কালাকোপা। নাম খুব একটা পরিচিত হয়নি এখনো। তাই বাড়তি মানুষের ভিড় নেই। কালাকোপার পাশের গ্রাম বান্দুরা। এখানে পৌঁছতে আপনার সময় লাগবে বড়জোর ২ ঘণ্টা।
কি কি দেখবেন:
রাধানাথ সাহার বাড়ি
জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত হলেও কালাকোপা-বান্দুরার প্রাচীন নকশার বাড়িগুলো মূলত এখানে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আসা ধনী পরিবারগুলোর। এর মধ্যে একটি রাধানাথ সাহার বাড়ি। বাড়ির স্থাপত্যশৈলী দেখলে আপনাকে মানতেই হবে ভদ্রলোকের রুচি ছিল। তবে বাড়িটির নাম এখন ‘আদনান প্যালেস’। বাড়ির নতুন মালিক এই নামকরণ করেছেন।
কোকিলপেয়ারী জমিদার বাড়ি
আনুমানিক ২০০ বছরের পুরনো বাড়ি এটি। অন্যান্য স্থাপনাগুলোও তাই। স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলে বাড়িগুলো সম্পর্কে নানান গল্প শোনা যায়। তবে কোকিলপেয়ারী কি জমিদার ছিলেন নাকি জমিদার পত্নী তা জানা যায়নি। আনসার ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলে প্রথমে পাবেন একটি ভাঙ্গা মন্দির। তারপরের বাড়িটিই কোকিলপেয়ারীর জমিদার বাড়ি।
উকিল বাড়ি
কোকিলপেয়ারী জমিদারের চমকপ্রদ বাড়ির উকিল বাড়ির অবস্থান। এটিও সেই সময়ের অভিজাত একটি স্থাপনা। তবে বর্তমান মালিকের পেশা অনুযায়ী নাম পেয়েছে উকিল বাড়ি।
জমিদার ব্রজেন সাহার ব্রজ নিকেতন
উকিল বাড়ির পরই এটির অবস্থান। বর্তমানে জজ বাড়ি নামেই বেশি পরিচিত। কারণ পরিত্যক্ত বাড়িটিতে একসময় এসে বাস করতে শুরু করেন এক বিচারক। জজ বাড়ি যেন কালাকোপার প্রাণ। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে বাজার। সুন্দর কারুকার্যময় বাড়িটি পরিদর্শনে বাড়তি উপযোগ যোগ করবে পোষা চিত্রা হরিণ।
শ্রীযুক্ত বাবু লোকনাথ সাহার বাড়ি
মঠবাড়ি বা তেলিবাড়ি নামে খ্যাত এই বাড়িটি। বিশাল বাড়িটি এখনো অক্ষতই আছে বলা চলে। তবে বাড়ির দেয়ালে নতুন রং প্রমাণ করে এটির পরিচর্যাও হয় যথেষ্ট। তা তো হবেই কারণ বাড়িটিতে এখন ২৯ নং আনসার ব্যাটালিয়নের বাস। শোনা যায়, লোকনাথ বাবুর ছিল তেলের ব্যবসা। সেই থেকেই নাম তেলিবাড়ি। কয়েকটি দালান মিলিয়ে এই তেলিবাড়ি। বিশেষ করে ইছামতীর তীরে অবস্থিত তেলিবারি মহল দুইটি নজর কাড়ে ভ্রমণকারীদের।
মধুবাবুর পাইন্না বাড়ি
পাইন্না বাড়ির স্থাপত্যশৈলীও নজর কাড়বে আপনার। বাড়ির বারান্দা, দরজা, জানালাসহ বিভিন্ন অংশে রয়েছে সূক্ষ্ম কারুকাজ। এই বাড়ির তিন মালিকের একজন মধুবাবু পানের ব্যবসা করে ধনী হয়েছিলেন বলে বাড়িটির এমন নাম!
পোদ্দার বাড়ি ও কালী বাড়ি
এই বাড়ি দু’টোও বেশ কাছাকাছিই অবস্থিত। নির্মাণশৈলীও একই ঘরানার।
খেলারাম দাতার বিগ্রহ মন্দির
পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে সাজানো মন্দিরটি যেন শান্তিরই প্রতিরূপ। এটিও প্রায় ২০০ বছর পুরনো। প্রাচীন ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরটি। মন্দিরের পাশেই আছে বিশাল একটি পুকুর। খেলারামকে নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে প্রচলিত আছে নানান গল্প। নিজে যেয়েই না হয় শুনবেন সেগুলো! ভালো লাগবে।
মহামায়া দেবীর মন্দির
কালাকোপা- বান্দুরার আরেকটি প্রাচীন উল্লেখযোগ্য স্থাপনা মহামায়া দেবীর মন্দির। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই মন্দিরে কোনো দেবীর পূজা হয় না। পূজা হয় একটি প্রাচীন গাছের গুঁড়ির। গাছটিকে আনা হয়েছিল ঘর বানানোর জন্য। কিন্তু কাটতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। মরা গাছের গুড়ি চিরে বেরিয়ে আসে রক্ত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা গাছটিকে পবিত্র মনে করেন এবং একে ঘিরে গড়ে তোলেন মন্দির। ১৩৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি আজও তেমনি আছে।
জপমালা রাণীর গির্জা
উপরে উল্লেখিত স্থাপনাগুলো থেকে একটু দূরে হাসনাবাদে অবস্থান জপমালা রাণীর গির্জা। তবে হেঁটেই যেতে পারবেন এখানে। এলাকার নামে হাসনাবাদ গির্জাও ডাকেন অনেক জায়গাটিকে। ১৭৭৭ সালে নির্মিত হয় গির্জাটি। গির্জার ছাদে আছে একটি বিশাল ঘণ্টা। গথিক শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন গির্জাটি গাছ-গাছালিতে ঘেরা।
ইছামতী নদী
ইছামতী নদী আসলে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। কারণ নদী কালাকোপা-বান্দুরাকে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে নদীর সাথে আপনার দেখা হবেই। আর বাংলার নদী মানেই তো মন জুড়ানো অপার শান্তি।

গুগল ম্যাপে দেখে নিন দোহারের অবস্থান।
কীভাবে যাবেন:
একেবারে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ুন। যেহেতু শীতকাল, দিন ছোট তাই শুরুটা দ্রুত করাই ভালো। গুলিস্তান, বাবুবাজার, কেরানীগঞ্জ, সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী থেকে সরাসরি কালাকোপা-বান্দুরার বাস পাবেন। ভাড়া ৭০ থেকে ১০০ টাকা। খাবার দোকান আছে। ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যেই দুপুরের খাবার হয়ে যাবে। আর আদনান প্যালেস এর প্রবেশ মূল্য নির্ধারিত করা আছে, ৩০ টাকা। ব্যাস আর কোনো খরচ নেই।
গ্রীক আর্কিটেকচারের অনন্য নিদর্শন কালাকোপা-বান্দুরার বাড়িগুলো। পাশাপাশি গ্রামে হওয়ায় সবুজ ছাওয়া দিকে দিকে। কাছেই মৈনট ঘাট। এখানে বেড়ানো শেষে যেতে পারেন ঐদিকটাতেও। তবে শীতের সময় শান্ত পদ্মা দেখতে বর্ষার উত্তাল সমুদ্রের মতো লাগবে না এটা মাথায় রাখবেন, তাহলে অযথা হতাশ হতে হবে না। শুভ ভ্রমণ।

Post Copied From:Washif Rashad Nibir‎>Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment