বাজেট ট্যুর দার্জিলিং, মিরিক, কালিম্পং

অপরুপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের হাত ছানি দিয়ে ডাকে দার্জিলিং। যতদূর চোখ যায় যেন পাহাড়ের গায়ে পাহাড় হেলান দিয়ে আছে। শহরে যেমন উঁচু উঁচু দালান আকাশ ছুঁয়ে যায় ঠিক তেমনি দার্জিলিং এ উঁচু উঁচু পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে। মেঘ যেন ভেসে ভেসে পাহাড়কে সাদা চাদরে মুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মেঘ পাহাড়ের এই খেলা দেখতে হলে আসতে হবে দার্জিলিং এ, সাথে দেখে নিতে পারেন মিরিক ও কালিম্পং। আমি দার্জিলিং এ গিয়েছি ৬ বার। সব বর্ডার দিয়েই যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। আসি এবার ভিসার কথায়-

ভিসাঃ বাই রোডে যেতে চাইলে বাংলাবান্ধা (ফুলবাড়ি) বর্ডার দিয়ে ভিসা নিতে হবে। নোটঃ চেংরাবান্ধা (বুড়িমারি) বর্ডার দিয়ে অনেক ঘুরে যেতে হবে সাথে বেশ সময়ও যাবে। আর যারা বাই এয়ারে যেতে চান তারা ঢাকা-কলকাতা-বাগডোগরা রুট ব্যবহার করতে পারেন। কাগজ পত্র ঠিক থাকলে ভরপুর ভিসা হয়ে যাবে।
এবার যাওয়ার পালা। আপনি যে বর্ডার দিয়েই যান না কেন শিলিগুড়ি যেতেই হবে। আমি প্রথম গিয়েছিলাম ২০১১ সালের নভেম্বরে। এরপর আরও ৫ বার দার্জিলিং ঘোরার সুযোগ হয়েছে। রাতের গাড়িতে রওনা করে সকালে বর্ডারে পৌঁছে যাই। ফ্রেশ ও নাস্তা করার ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। ফ্রেশ হয়ে গরিবি হালে নাস্তা করি। তবে এখন কিঞ্চিৎ উন্নয়ন হয়েছে। ঝামেলা ছাড়াই বর্ডার পার হয়ে যাই, তবে বরাবরের মতো ২০০ টাকা করে দ্রুত কার্য উদ্ধার দণ্ড দিতে হয়েছে। বর্ডার পার হয়েই ভাড়ায় চালিত গাড়ি মিলবে গন্তব্য শিলিগুড়ি। আমরা দুই বন্ধু তাই ২ কদম হেঁটে খানাপিনা করে করে শিলিগুড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম।

দার্জিলিং: শিলিগুড়ি (এন.জি.পি) রেলওয়ে স্টেশন থেকে জীপ নিতে হবে । জীবনে কারও ডাক না পেলেও এখানে জীপের ড্রাইভারদের ডাক পাবেন নিশ্চিত। এটা প্রেম নয় সুতরাং তাড়াহুড়ার কিছু নেই একটা গেলে আরেকটা পাবেন। টাকা থাকলে রিজার্ভ করুন না হলে আমার মতো শেয়ার জীপে চলুন। ১২০ রুপীতে শেয়ার জীপে রওনা দিলাম দার্জিলিং এ। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং ৪ ঘণ্টার পথ। কিছু দূর পরেই শুরু হলো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। প্রথম বার যারা যাবেন আমি নিশ্চিত তারা দোয়া কালাম পড়া শুরু করবেন, কারণ ১৫/২০ সেকেন্ড পর পরই ডেঞ্জারাস টার্ন। একবার বামে তো একবার ডানে। মনে হবে যেন গাড়ির রেস চলছে! কিছু দূর যাওয়ার পর সব ভীতি কেটে গেলো তারপর দু’চোখ মেলে দেখতে থাকলাম দার্জিলিং এর সৌন্দর্য। চোখ জুড়িয়ে গেলো যাত্রার ক্লান্তি কখন যে দূর হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। কিছু দূর যাওয়ার পর মেঘ এসে পরশ বুলিয়ে গেলো। এই প্রথম মেঘ ছুঁয়ে দেখলাম। আর আফসোস হলো তাদের জন্য যারা উচ্চ বিত্ত হয়েও মেঘ ছুঁয়ে দেখতে পারল না। এতো টাকা থেকে কি লাভ যদি দু’চোখ মেলে এই পৃথিবীই না দেখতে পারি। অপার এই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। তবে গার্লফ্রেন্ড বা বউ থাকলে ভিন্ন কথা। এই যে বউের কথা মনে করে অনেকের মন খারাপ হয়ে গেলো। মন ভালো করার জন্য টি-ব্রেক। টি-ব্রেকে শুধু টি খেতে হবে এমন কোন কথা নেই কফিও খেতে পারেন। ২ ঘণ্টা পর বিরতিতে মমো খেয়ে নিলাম। আর ছবি যে তুলেছি কত তার ঠিক নেই। ১ম বার তো বিরতি পর্যন্ত আসতে আসতেই মেমরি ফুল হয়ে গিয়েছিল। যা হোক ৩০ মিনিটের বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু। আবার ডান বাম মানে সেই আঁকাবাঁকা পথ। দার্জিলিং এ নেমে পায়ে হেঁটে গেলাম মেল এর কাছাকাছি। দার্জিলিং এ তো অনেক ঠাণ্ডা কিন্তু ফেসবুকে ছবি দিয়ে তো গরম রাখতে হবে। সুতরাং Wifi আছে এমন হোটেল নিতে হবে। ৮০০ রুপিতে হোটেল নিলাম। চিতকাত না বেশ ভালই ছিল হোটেল সাথে Wifi ছিল ফ্রি। ফ্রেস হয়ে বিকেলে বের হলাম ঘুরতে। মেল থেকে দক্ষিণ দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে (উত্তর-দক্ষিণ না চিনলে বিপদ) এই রাস্তা ধরে কিছু দূর হাঁটলে দার্জিলিং জু, হিলারি-তেনজিং ক্লাব, মিনি পার্ক পরবে। নিজের পছন্দ মতো ঘুরে দেখুন। আমি যাই পরের দিন ঘোরার ব্যাবস্থা করি। আপনি যে হোটেলে থাকবেন ঐ হোটেলে বললেও গাড়ি/প্যাকেজ ম্যানেজ করে দিবে বা রাস্তায় অনেক ড্রাইভার কাম গাইড বিভিন্ন স্পটে ঘোরার অফার করবে। বলছি বলছি কোথায় কোথায় ঘুরবেন কি কি দেখবেন। দার্জিলিং এসেছেন যখন না দেখে তো আর যাবেন না।
১. টাইগার হিল ২. বুদ্ধিসট টেম্পল ৩. বাতাসিয়া লুপ ৪. জাপানিস টেম্পল ৫. ঘুম স্টেশন ৬. রক গার্ডেন ৭. টি গার্ডেন ৮. রোপ ওয়ে ৯. সেন্ট জোসেফ স্কুল ১০. দার্জিলিং জু ১১. হিলারি-তেনজিং ক্লাব। ১ দিনেই সব ঘোরাঘুরি শেষ হয়ে যাবে। আমরা রাত থেকে পরের দিন সকালে রওনা দিয়েছিলাম মিরিকের উদ্দেশ্যে।

কোথায় থাকবেনঃ দার্জিলিং এ যেদিকেই তাকাবেন সেই দিকেই হোটেল পাবেন। মেল এর কাছাকাছি ভালো মানের হোটেল আছে। আগে থেকে বুক না করলেও চলবে। ৭০০ থেকে ৩০০০ রুপির হোটেল মিলবে।
মিরিকঃ দার্জিলিং থেকে ১০০ রুপিতে শেয়ার জীপে রওনা করলাম মিরিকের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভার নেপালি গান ছাড়ল আর যাত্রাপথ যেন মধুর হয়ে উঠল। যাওয়ার পথে অনেক পাইন ট্রি দেখতে পেলাম। কিছু শুটিং স্পট ও টুরিস্ট স্পট দেখতে পেলাম কিন্তু শেয়ার জীপ বলে আর নামা হলো না। আফসোস করতে করতেই চলে আসলাম মিরিকে। মিরিক বাজার থেকে মিরিক লেক ৫ রুপির পথ। মিরিক লেকের কাছাকাছি একটি হোটেলে উঠলাম। ৯০০ রুপি পার নাইট। খুব ছোট্ট একটি পাহাড়ি শহর। দুপুরের পর বের হলাম আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য। বিকেলে ঘুরে দেখলাম মিরিকের মুল আকর্ষণ সুমেন্দু লেক। গাড়িতে তো অনেক ঘুরেছি এবার সুমেন্দু লেকের পাশে ১০০ রুপিতে ঘোড়াতে চড়ে একটু মজা নিলাম। লেক থেকে শহরটাকে দেখবেন মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে আবার মেঘের ফাঁক থেকে শহর উকি দিচ্ছে। এ যেন মেঘ শহরের খেলা। পরদিন হাফ ডে ট্যুর প্যাকেজ নিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখলাম ১. বোকার গুম্ফা (বুদ্ধিসট টেম্পল) ২. টি গার্ডেন ৩. রামিতে দারা (মিরিক ভিউ পয়েন্ট) ৪. সুইস কটেজ ৫. টিংলিং ভিউ পয়েন্ট ৬. নেপাল ভিউ পয়েন্ট। ২০১৮ সালে উপরোক্ত স্পটগুলো ঘুরেছি ২ জনে ৮০০ রুপিতে।

কোথায় থাকবেনঃ লেকের পাশে হোটেলে থাকায় ভালো। এখানে ৭০০/৮০০ রুপি থেকে শুরু করে অনেক রেটের হোটেল পাবেন। এছাড়াও অনেক লজ/কটেজ পাবেন।
কালিম্পং: কালিম্পং এ আমরা ছিলাম ২ দিন ১ রাত্রি। সকালে গেলাম ক্যাকটাস গার্ডেন দেখতে দারুণ লেগেছে। হরেক রকম বাহারি সব ক্যাকটাস। একসাথে এতো ক্যাকটাস আর ক্যাকটাসের ফুল দেখে মুগ্ধ হতেই হবে। পরিসরে ছোট হলেও কালিম্পং এ আসলে মিস করবেন না। প্রবেশ ভারতীয় নাগরিক ২০/- রুপি, বিদেশি ১০০/- রুপি। এরপর চলে গেলাম ডেলো তে প্যারাগ রাইডিং করতে। জনপ্রতি ৩০০০/- রুপি। ১৫ মিনিট আকাশে উড়ার অনন্য অভিজ্ঞতা। এমন সুযোগ খুব কম পাওয়া যায়। চাইলে টাকা উড়াতে পারবেন কিন্তু আপনি নিজে উড়তে পারবেন না। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। ডেলো থেকে একটু দূরে সায়েন্স সিটি। ছোট্ট পরিসরে সায়েন্স সিটি ঘুরে দেখলাম। সায়েন্স সিটির ভিতর থেকে বাহিরটাই বেশি সুন্দর লেগেছে। বিকেলে গেলাম শহর থেকে ৫শ/৬শ ফুট নিচে কালিম্পং এর বিগ টেম্পল মঙ্গল ধাম মন্দিরে। নির্মল শান্ত পরিবেশ ভালই লেগেছে। ২য় দিন হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পরলাম। আজকের প্ল্যান র‍্যাফটিং করে শিলিগুড়ি ফিরবো। র‍্যাফটিং করার জন্য কিছু প্যাকেজ আছে। যেমনঃ ৬/৮ জন ৫-৭ কি.মি. ৫০০০/- রুপি, ৪/৬ জন ২-৩ কি.মি ৩০০০/- রুপি। সাঁতার না জানলেও চলবে। শুধু রশি ধরে শক্ত করে বসে থাকতে পারলেই হবে। সিকিমের পানিতে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা মিস করলে পরে পস্তাতে হবে। এতদিন হেলায় গা ভাসিয়েছি এবার পানিতে গা ভাসালাম। ভিডিও’র জন্য ৩০০/- রুপি বারতি দিতে হয়েছে। চাইলে আপনিও র‍্যাফটিং এর অভিজ্ঞতা নিতে পারেন, আশাকরি অনেক ভালো লাগবে। আমি সময় স্বল্পতার জন্য কালিম্পং এর বিখ্যাত ঘন সবুজ অরণ্য লোলেগাঁও দেখতে পারিনি। আপনারা মিস করবেন না। কালিম্পং এ চমৎকার ২ টি দিন কাটানর পর গাড়ি ধরলাম শিলিগুড়ির।

কোথায় থাকবেনঃ আপার কার্ট রোডে অনেক হোটেল আছে। রিংকিংপং রোডে কিছু হোটেল মিলবে। তবে অনেক লজ/ কটেজ আছে।
কেমন করে ফিরবেন তা মনে হয় না আর বলতে হবে। আর টাকা শেষ হলে তো কথায় নেই, দেখবেন আপনি এমনিতেই বাড়ি পৌঁছে গেছেন।
বাজেটঃ ১৭/১৮ হাজার টাকার মধ্যে ট্যুর হয়ে যাবে।
নোটঃ প্যারাগ রাইডিং, র‍্যাফটিং করলে বাজেট একটু বাড়বে।
রুটঃ ঢাকা থেকে বাই রোডে বাংলাবান্ধা-শিলিগুরি-দার্জিলিং-মিরিক-কালিম্পং। বাই এয়ারে, ঢাকা-কলকাতা-বাগডোগরা।
খাওয়া-দাওয়াঃ ডাক্তারের বিধি নিষেধ ছাড়া যা মন চাইবে তাই খাবেন।
পরিস্কার পরিছন্নতা বজায় রেখে ভ্রমণ করুন। পৃথিবীটাকে সুন্দর রাখুন।

Source:

Share:

Leave a Comment