মর্মর নগরী মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ

বিএসএফের বিরাট লম্বা পাঞ্জাবি অফিসারটি সোজা সাপ্টা বলে দিল “যাবতাক হামারা বড়া সাব নেহি আয়েগা, তাবতক এ ক্যামরা নেহি দে সাকতে”। সকাল সকাল কেমন লাগে, গেদে সীমান্তে সহযাত্রী জুবায়ের তাঁর ডিএসএলআর শুধু তাক করেছিল, আর সাথে সাথে ছো দিয়ে কেড়ে নিয়েছে সে। আমরা অন্য তিনজন ততক্ষণে বিএসএফের চেকিং শেষ করে এপারে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ওর দেরি দেখে আবার পিছনে ফিরে গিয়ে দেখি এই অবস্থা। আসলে গেদে বর্ডারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শ্রাবণের সকালে এতই মোহনীয় ছিল, শখের ফটোগ্রাফার জুবায়েরের ক্যামেরা আপনা আপনি বের হয়ে গেছে। যাইহোক অনুনয় করে বললাম, হাম লোক কা ট্রেন হে, এক মিস হোগা তো, সব বরবাদ হ জায়েগা। বাচ্চা সামাঝকে মাফ কার দিজে। জুবায়েরও সরি বলল। পাঞ্জাবি অফিসার হাসিমুখেই ক্যামেরা ফেরত দিলেন।
মুর্শিদাবাদ বেড়ানোর ইচ্ছে বহু দিনের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন পদ্মার পাড়ে গেলেও, ওপাড়ে মুর্শিদাবাদ যেতে মন চাইত। আমাদের নাটোরের রানী ভবানীর রাজ্যের অংশ ছিল মুর্শিদাবাদ। আর সাথে রয়েছে ইতিহাসের এত এত আঁকর। সব মিলিয়ে সোনায় সোহাগা।

রয়েল এর এসি কোচে বেশ আরামেই দর্শনা এসে খুব অল্প সময়ে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশান পার্ট শেষ করে, ত্রিশ টাকা করে ভ্যান ভাড়ায় গেদে গেলাম। আর সেখানেই ওই ক্যামেরা কান্ড। যাইহোক, বিনা টাকাতেই সে কাণ্ড শেষ হওয়ায় আমরা ফুর্তি নিয়েই গেদে চলে এলাম, মানে গেদে রেল স্টেশানে। ভারতীয় ইমিগ্রেশান শেষ করে, সবাই রুটি, ডিম আর সবজি দিয়ে গরম গরম নাস্তা খেলাম। তারপর টাকা রুপি করে নিলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল, ধূমায়িত গরম চা খেয়ে মাত্র ৫ রুপির টিকেট কেটে ‘গেদে লোকাল’ ট্রেনে চেপে বসলাম। ১৫ মিনিট পরে নেমে গেলাম মাজদিয়া বাজার স্টেশানে। ওখানকার ভিড় দেখে বুঝলাম মাজদিয়া থেকেই হয়ত গেদে লোকাল ভর্তি হওয়া শুরু করে। স্টেশান থেকে নেমে হাতের বামে ২ মিনিট এগুলেই কৃষ্ণনগরের বাস। ২২ রুপির ভাড়ায় আমরা ঘন্টা খানেকের মধ্যে চলে এলাম, নদিয়া জেলার হেড কোয়ার্টার কৃষ্ণনগরে। পথিমধ্যে একেবারে গ্রামীণ পরিবেশ, সবুজ বিস্তীর্ণ পাট ক্ষেত, আর ছোট ছোট লোকালয়। নদিয়াকে অন্য অঞ্চলের চেয়ে একটু পিছিয়ে পরা মনে হল। প্রিয় গোপাল ভাঁড় আর তাঁর রাজা কৃষ্ণ চন্দের কৃষ্ণনগরে এসে আমরা সময়ের একটু আগেই লাঞ্চ সারলাম, সাথে গোপালের প্রিয়, আমাদেরও প্রিয় রসগোল্লা। কৃষ্ণনগরের হাই রোডে কলকাতা থেকে বহরমপুরের উদ্দেশে ছেড়ে আসা বাসের যাত্রা বিরতি। আমরা সেখান থেকেই বহরমপুরের বাসে উঠলাম, মাত্র ৭০ রুপির বাস ভাড়ায় আমরা ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তর হয়ে বহরমপুর আসলাম। যেখানে ঢাকায় উত্তরা থেকে গুলিস্তান আসতেও এখন ১০০ টাকা লাগে। গরীবের কথা আমাদের দেশে কে ভাবে! যাহোক, প্রসঙ্গে ফেরত আসি। বহরমপুর বাস টার্মিনাল থেকে নেমে হাতের বাম দিকে এগিয়ে গেলে অনেকগুলো হোটেল। রাত থেকে জার্নি করছি বিধায় আমরা ভালো মানের সোনালি বাংলা হোটেলটি নিলাম। সেখানে গরম শাওয়ার আর একটু রেস্ট নিয়ে বের হলাম ‘লালবাগ’ তথা মূল মুর্শিদাবাদের দিকে।

বহরমপুর শহর পেরিয়ে আমরা যখন লালবাগে ঢুকছিলাম তখন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে এসে কেমন যেন গা ছমছম করছিল। আমরা প্রথমেই নামলাম হাজারদুয়ারী প্রাসাদ ও ইমামবাড়া প্রাঙ্গনে। সেখানে চল্লিশ রুপির টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম হাজারদুয়ারীর ভেতরে। যাদুঘরে অনেক ঐতিহাসিক জিনিস খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। যাদের ইতিহাস পছন্দের, তাঁরা হয়ত সেই পোশাক গুলতে আজও ইংরেজ ও নবাবের সৈন্য খুঁজে পাবেন। পাবেন ঝাড়বাতির নীচের সিংহাসনে মকুট পড়া নবাব কে। আর পালঙ্ক, গহনা বা আসবাবপত্রের ভেতরে বেগম সাহেবাদের। কোথাও কোথাও নির্জনে তাঁদের হাহাকারও শুনতে পাবেন। আমরা অবশ্য তাড়া থাকায় ওসবে গা করলাম না। তাঁদের মায়াজাল পেরিয়ে বাইরে আসলাম ইমামবাড়ার সামনে ছবি তুলতে। কারন ওটা শুধু মহররমের মেলার সময়ই খোলা হয়।

সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, এক কোচোয়ান অনেকক্ষণ ধরে সাথে সাথে ঘুরছিল, আর নানান ইতিহাস বলে যাচ্ছিল। তাঁর ইচ্ছে বাকি সফরে আমরা তাঁর সঙ্গী হই। ভদ্রলোকের ধৈর্যের কাছে আমরা সমর্পিত হলাম। কিন্তু কিছুদূর যাবার পরেই তাঁর দুর্বল ঘোড়া কেন জানি আর যেতে চাচ্ছিল না। হয়ত ক্ষুধায় আর ক্লান্তিতে আমাদের বইতে চাচ্ছিল না। অগত্য নবাবদের মত নগর বেড়ানো বাদ দিয়ে, আমরা আবারও অটো ধরলাম। নবাবদের বাগানবাড়ি লালগোলা, সেখান থেকে মীর জাফর আলী খাঁর বাড়ি, তারপর তাঁদের বংশধরদের কবর। সরু রাস্তা আর অবহেলিত জনপদ দেখে হয়ত মনেই হবে না একসময় ওনারা কত দাপটের ছিলেন। আজকাল পাড়া মহল্লার পাতি নেতাও কত দাপটের সাথে চলে। আর উনারা ছিলেন, বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা মিলিয়ে এত বিশাল অঞ্চলের হর্তা-কর্তা। কবরের ওখানে হয়ত টিকেট লাগত, আমি ভেতরে গেলাম কাউকেই দেখলাম না। কিছুক্ষণ পরে ফরিদ ভাই যখন আসল, তখন কেউ একজন পাশের ঘর থেকে ঝিমুনে কাটিয়ে উঠে বলল, দাদা টিকেট নিতে হবে ত। মীর জাফর আলী খাঁ, যিনি সে সময়ের অন্যতম ধনী জগত শেঠ, রাজ বল্লভ, রায় দুর্লভ, উমি চাঁদ, ঘসেটি বেগমদের সাথে হাত মিলিয়ে নবাবের সাথে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। ব্যক্তি স্বার্থে বিসর্জন দিয়েছিলেন দেশের স্বার্থ। যার চূড়ান্ত পরিণতি ২০০ বছরের গোলামী।

আমরা যখন নবাব কাটরায় আসলাম, তখন সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দ্বাররক্ষীকে বাংলাদেশ থেকে এসেছি বলে অনুরোধ করায়, তিনি অনুমতি দিলেন। এত আগে এত চমৎকার নান্দনিক মসজিদ দেখে আমি সত্যি অভিভূত হয়ে গেলাম। এত বড় নান্দনিক কারুকার্যের মসজিদটি আজ শুধু জাদুঘর ভেবে কষ্টই হচ্ছিল। আরও খারাপ লাগল এক কোণে পরে থাকা ছোট্ট এক কবর দেখে। কবরটি যিনি বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে নিজেরনামে নতুন শহরের গোঁড়াপত্তন করে মুর্শিদাবাদ রাখেন, সেই নবাব মুরশিদকুলি খাঁ’র!

আমাদের শেষ গন্তব্যছিল এক সময়ের নবাবদের রাজপ্রাসাদ মতিঝিলে। আলোর ঝলকানির কারনে রাতের মতিঝিলই আকর্ষণীয় বলে স্থানীয়দের কাছে জেনেছিলাম। সত্যি বলতে কি, আমার কাছে বহরমপুর- মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল এই মতিঝিল ইকোপার্ক। ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর উদ্দেশে এই মতিঝিল থেকেই রওনা দিয়েছিলেন সিরাজ। কিন্তু নিয়তির পরিহাস আর এখানে ফেরা হয়নি তাঁর। ভাগীরথীর অন্য পাড়ে দাফন করা হয় তাঁকে। ধংস করা হয় মতিঝিলের প্রাসাদ। যারা এদিকে বেড়াতে আসবেন তাঁরা ইচ্ছে করলে, মতিঝিলের লেকের ধারে খুবই সুন্দর কটেজগুলোতে থাকতে পারেন। হোটেলের চেয়ে একটু বেশী, ১৫০০ থেকে ২ হাজার রুপীতে এমন চমৎকার পরিবেশে কাটানোর সুযোগ হাতছাড়া না করাই ভাল। আর সন্ধ্যায় উপভোগ করতে পারবেন ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর উপস্থিতিতে চমৎকার লাইট এন্ড সাউন্ড শো।

রাতে যখন ভাগীরথীর পাড় দিয়ে অটোয় করে বহরমপুর শহরে ফিরছিলাম। ভরা-নদীর প্রাণ জুড়ানো শীতল বাতাসে এক ধরনের অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বাতাসে ভেসে আসছে অজস্র মানুষের অস্পষ্ট ধ্বনি। তাঁরা যেন জানতে চাইছে কেন আসলে এখানে? আমি বললাম, ইতিহাস জানতে। তাঁরা রেগে জানতে চাইল, কি জানলে? বললাম, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না.
Source: Sardar M Mohiuddin‎<Travelers of Bangladesh (ToB)

Share:

Leave a Comment